লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে মসজিদে তর্কাতর্কির জেরে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় স্থানীয় জামায়াত ও দলটি ভেঙে গঠন করা এবি পার্টির স্থানীয় কর্মীদের পাশাপাশি তিন নেতাকে নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ। প্রশাসন ও তদন্তকারী সংস্থার দাবি, জামায়াত ও এবি পার্টির নেতাকর্মীরাই সেদিনের ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছে।
গত ২৯ অক্টোবরের ওই ঘটনাই নয়, বুড়িমারীতে আগেও নানা সহিংসতা, নৃশংসতায় নাম এসেছে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সেদিনের ঘটনার ভিডিও দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করা হচ্ছে।
সেদিন বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন শহীদুন্নবী জুয়েল। সেখানে তর্কাতর্কির পর যা ঘটেছে, তা গোটা বাংলাদেশকেই হতভম্ভ করে দেয়।
শহীদুন্নবী ও তার এক বন্ধু কোরআন অবমাননা করেছেন গুজব ছড়িয়ে দেয়ার পর সেখানে যায় স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন। তাদের উপস্থিতিতে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহ টেনে নিয়ে আগুন দেয়া হয়।
ঘটনাটি অরাজনৈতিক হলেও এই হত্যায় যারা সম্পৃক্ত, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। স্থানীয় রাজনীতিক, প্রশাসন, পুলিশের অনুসন্ধান বলছে, বেশিরভাগই জামায়াত ও এবি পার্টির কর্মী।
এ কারণে আসামি না হলেও নজরদারিতে আছেন জামায়াতের নেতা ও বর্তমানে এবি পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আবু হেনা মো. এরশাদ হোসেন সাজু।
যদিও তিনি বলছেন, ওই বাজারে জামায়াতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে সত্যি। তবে সেদিন জামায়াত ছাড়াও হেফাজত, শর্শিনা, চরমোনাই ও ইসলামী ঐক্যজোটের কর্মীরাও ছিলেন।
পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়ার স্থান
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় রুকন ও মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিতে ঝোলা জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ভায়রা ভাই আনোরুল ইসলাম রাজু ও জেলা সেক্রেটারি আতাউর রহমানের দিকেও চোখ রাখছে পুলিশ।
স্থানীয় রাজনীতিক ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আন্দোলনের নামে সহিংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে রায়ের পর বুড়িমারীতে যত সহিংসতা হয়েছে, তার পেছনে জামায়াত ও এবি পার্টির এই নেতারা ছিলেন।
বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেদিন যেসব স্লোগান দিয়ে হামলা হয়েছে সেগুলো এখানে জামায়াত ছাড়া এর আগে কেউ ব্যবহার করে না। নতুন গঠিত এ বি পার্টির নেতা-কর্মীরাও এসব স্লোগানই ব্যবহার করছে।’
নিশাত বলেন, ‘সাজু হচ্ছেন মূল কালপ্রিট। যেহেতু তদন্ত চলছে, তাই বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে ভিডিওতে সাজুর চাচাত ভাই মোশারফ ও আনুকে ২৯ অক্টোবরের নৈরাজ্যে নেতৃত্ব দিতে দেখেছি। ভিডিও দেখে এদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।’
শ্রীরামপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও বুড়িমারীর প্রবীণ বাসিন্দা মুসা আলি বলছিলেন, 'এখানে কোনো কিছুর ১৯/২০ হলেই বিশৃঙ্খলা হয়। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর এখানে গান পাউডার দিয়ে অনেক বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে। ভিডিওতে দেখেছি, ওই অমানুষগুলোই সেদিনের মবে (দল বেঁধে হামলা) অংশ নিয়েছে।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুলের সঙ্গে নির্বাচন করে হেরে গিয়েছিলেন সাজু। এ নিয়ে ক্ষোভ ছিল। শহীদুন্নবী হত্যার দিন বাবুল ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পরেও সাজুর সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুন নাহার নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, ঘটনা শুনে তারা যখন ছুটে যান, তখন সেখানে পাঁচ থেকে সাত শ মানুষ ছিল। তাদের শান্তও করে ফেলেন তারা। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দলে দলে মানুষ আসতে থাকে। তখন বুড়িমারী ইউপির চেয়ারম্যান আবু সাঈদ দেওয়ান নিশাত মাইক নিয়ে সবাইকে আবার শান্ত করার চেষ্টা করেন।
পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল বলেন, ‘শান্ত হয়ে আসা পরিবেশটা যখন বিশেষ স্লোগানে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তখনই বুঝতে বাকি থাকে না ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী বা জামায়াত এখানে যোগ দিয়েছে। তখনই ইউএনওকে বলি ২০১৪-১৫ সালের পরিস্থিতি এসে যাচ্ছে। তদন্ত যেহেতু চলছে, তাদের নাম বলব না। তবে এ স্লোগান তাদেরই, এটা সবার কাছে পরিষ্কার।’
তিনি বলেন, ‘সাজুর (এবি পার্টির নেতা) বাড়ি বুড়িমারী বাজারের কাছে। তার পরিবারের সদস্য ও কর্মীদের সেদিনের সহিংসতায় বড় ভূমিকা নিতে দেখা গেছে।’
তবে বর্বরতায় জামায়াত নেতা-কর্মীদের কোনো দায় নেই বলে দাবি করেছেন জামায়াতের সাবেক জেলা সেক্রেটারি আলাউল ইসলাম ফাতেমী পাভেল। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যত অভিযোগ ও মামলা, তার প্রায় ৯৯ ভাগই অনুমান ও কল্পনানির্ভর। তাছাড়া হত্যা, অগ্নিসংযোগ এসব বিষয় তো জামায়াতে ইসলামী ঘৃণা করে। এর সঙ্গে যোগ দেওয়ারই তো কিছু নেই।’
সেদিনের স্লোগানের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পাভেল বলেন, ‘এগুলো মুসলিম উম্মাহর স্লোগান। এটা সারা বিশ্বের ইমানদার মুসলিমরা ব্যবহার করেন। সেদিন দেখলাম হেফাজতও এই স্লোগান দিচ্ছে।’
এবি পার্টি নেতা এরশাদ হোসেন সাজু বলেন, ‘যে ঘটনা বুড়িমারীতে ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। কোনো মানুষ এটা সমর্থন করতে পারে না। যারা এটা করেছে, তারা মানুষ না।’
শহীদুন্নবী জুয়েল (বাঁয়ে), পাটগ্রাম থানার সামনে দগ্ধ দেহ। ছবি: নিউজবাংলা
সহিংসতায় তার সমর্থকদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সাজু বলেন, 'আমি ১০ মাস হলো জামায়াতের সঙ্গে নেই। আমার দল এবি পার্টির কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি বা লোকবল বুড়িমারীতে নেই। বুড়িমারী জামায়াতের সঙ্গেও আমার ঝামেলা থাকায় তারা আমাকে সেখানে ঢুকতে দেয় না।’
ঘটনার দিন রাজধানী ঢাকায় ছিলেন দাবি করে সাজু বলেন, 'এটা ঠিক জামায়াত বুড়িমারী বাজারে শক্তিশালী অবস্থানে আছে। সেখানকার বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই দলটির কর্মী। তবে বাজারের চারপাশে জামায়াত, হেফাজত, শর্শিনা, চরমোনাই ও ইসলামী ঐক্যজোটের একাধিক মাদ্রাসা রয়েছে। ঘটনার ভিডিওতে তাদের কর্মীই বেশি দেখেছি।’
সাজু বলেন, ‘জামায়াত জড়িত কি না, জানি না। তবে ওখানকার ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম সবাই বুড়িমারী জামায়াতের আমির মোজাম্মেলের লোক। তাকে ধরলেই মূল ঘটনা জানা যাবে। তার কারণে তো আমিও বুড়িমারী ঢুকতে পারি না।
‘আর জামায়াত কিছু করে থাকলে তা নিশ্চয়ই জেলা আমির ও সেক্রেটারির নির্দেশে হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসা করলেই হয়।’
জামায়াতের বর্তমান জেলা সেক্রেটারি প্রভাষক আতাউর রহমানের দাবি, ঘটনার পেছনে তার সংগঠন কোনোভাবেই জড়িত নয়।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, 'এ ঘটনায় কারা জড়িত তা তো ভিডিও ফুটেজেই স্পষ্ট। আর ইন্ধনদাতার কথা বলছেন, সেটা তো মোবাইল ট্রাক করলেই বোঝা যাবে।’
জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আতাউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ’২০১৪ সালের এক মামলায় সেদিন আমার লালমনিরহাটে হাজিরা ছিল। আমি সেখান থেকেই ঘটনা শুনতে পাই। এ ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও নিন্দনীয়।’
এই ঘটনায় বুড়িমারীর শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি হোসেন আলী জড়িত দাবি করে জামায়াত নেতা বলেন, ‘তাকে ধরলেই ঘটনার পেছনের সবাইকে জানা যাবে। তবে নিরাপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়, এটাই বলব।’
অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেন, 'কয়েকটা দিন সময় লাগবে পুরো ঘটনার জট খুলতে। তবে একটি গোষ্ঠী কোরআন অবমাননার গুজবের বিষয়টি পুঁজি করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণকে মুখোমুখি করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এটা স্পষ্ট।’
পুলিশ সুপার বলেন, ‘তদন্ত শেষে মূল আসামিদের সম্পর্কে জানা যাবে। তবে তারা যে স্লোগান ও ধ্বনি ব্যবহার করেছে, তা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের। এদের অনেকেই আগের সহিংসতা ও অগ্নিসন্ত্রাস মামলার আসামি। তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও সবার জানা।’
পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা যে পরিকল্পিত ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ তা বুঝতে কষ্ট হয় না। তবে এটা তদন্তের বিষয়। এর পেছনে যারাই থাকুক না কেন এবং যাই থাকুক না কেন, সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হবে।’