বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাঁওতাল পল্লিতে হামলা: বিচারের গতি ধীর

  •    
  • ৬ নভেম্বর, ২০২০ ১১:৩২

২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সকালে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার সময় তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া ও গুলির ঘটনা ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামে তিন জন নিহত হন। পিবিআই প্রতিবেদন দিলেও নারাজি দেন বাদী। তদন্তের ভার যায় সিআইডির কাছে। তারা এখনও প্রতিবেদন দেয়নি।

কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের মতোই পরিণতি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লিতে হামলা মামলার। ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার চার বছরেও বিচার পেলেন না ভুক্তভোগীরা।

২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সকালে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার সময় তাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া ও গুলির ঘটনা ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামে তিন জন নিহত হন।

বাড়িঘরে পুলিশের আগুন দেয়ার ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশও হয় সে সময়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়।

তবে বিচার আটকে আছে নানা জটিলতায়। চার বছরেও প্রতিবেদন না দেয়া আর প্রধান অভিযুক্তরা গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ সাঁওতাল নেতাসহ নিহত-আহতের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তরা।

বেঁচে থাকতে সাঁওতাল হত্যা মামলার বিচার দেখতে চান এ মামলার বাদী থমাস হেমব্রম।

জেলার সহকারী পুলিশ সুপার (সিআইডি) তানভীর হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন শিগগির আদালতে জমা দেয়া হবে। আমরা চেষ্টা করছি এ বছরেই যাতে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়।’

 

হামলার ওই দিনটিতে প্রতি বছর ‘সাঁওতাল হত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করছে পল্লির বাসিন্দারা। শুক্রবার চার বছর পূর্তিতে সেখানে শোকযাত্রা, পুষ্পস্তবক অর্পণ, মোমবাতি প্রজ্বালন, স্মরণসভা ও সমাবেশসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

ভিডিওতে দেখা যায় পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মীরা সাঁওতালদের ঘর-বাড়িতে আগুন দিচ্ছে

 

মাদারপুর গ্রামের বাসিন্দা রফায়েল মুরমু বলেন, ‘হামাগরে (আমাদের) এহানকার বাপ-দাদার ভিটে-সম্পদ থাকি তারা সড়াতি চায়। হেই (সেই) কারণে তারা (অভিযুক্তরা) হামাগরে উপরত (ওপর) হামলা, লুতপাত (লুটপাট) আর গুলি করে তিন জনক মারছে। হামাগরে জমিন ফিরৎ চাইছি আর ভাই হত্যার বিচার চাইছি।’

জয়পুর গ্রামের ইলিভা মার্ডি বলেন, ‘এ জমিতে অনেক দিন থ্যাকি বসবাস করেতেছি। সেদিন কোন নোটিশ না দিয়া সকালে হুটহাট ওচ্ছেদ (উচ্ছেদ) অভিযান করি তিন ভাইকে গুলি করিল (করা) পুলিশে। হেরপর (এরপর) ঘরে আগুন জ্বালাইয়া সব পুড়িলো, এক-এক করি সব কিছু লুট করা শেষ করলো সন্ত্রাসীর দল। ওদিন মারডাং (মারপিট) করিল সাঁতালদের। মারডাং খায়া কেউ হাত-পাও, কেউ চোখ হারাইল (হারানো)। এলাও (এখনো) পঙ্গু হয়া (হয়ে) পড়ি আছে অনেকগুলে হামাদের (আমাদের) মানুষ। এদের খোঁজ কেউ কোনদিন নিলো না। এই জমিনের কারণে তিন নিরহ (নিরীহ) ভাইকে হারাইছি; দরকার হলি (হলে) আরও তিনশ জন মরমো (মারা যাওয়া); তাও জমিন (জমি) দেবো না।’

৬ নভেম্বর ঘটনার কয়েকদিন পর মিলের ওই এক হাজার ৮৪২ একর জমির সিংহভাগই সাঁওতালরা দখলে নিয়েছে। এসব জমিতে ছাপড়া ও টিনশেড ঘর নির্মাণ করে বসতি গড়েছেন তারা।

 

যে জমির জন্য হামলা-হত্যা

১৯৬২ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড আখ চাষের জন্য সাপমারা ও কাটাবাড়ী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের এক হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে।

এর মধ্যে ৭৩ শতাংশ মুসলমান ও ২৭ শতাংশ সাঁওতালদের জমি। এই জমি অধিগ্রহণের পর সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম নামে নামকরণ করা হয়।

অধিগ্রহণকৃত জমি মিল কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকবছর আগে ইজারা নিয়ে ধান, পাট ও তামাকসহ বিভিন্ন আবাদ করে আসছিল সাঁওতালরা। অধিগ্রহণ চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ এনে ২০০২ সালে বাপ-দাদার জমি ফেরত চেয়ে আন্দোলন শুরু করেন তারা।

২০১৪ সালে তারা গঠন করে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি। এরপর চলতে থাকে সাঁওতাল-বাঙালিদের ভূমি উদ্ধারের কর্মসূচি।

২০১৬ সালের ১ জুলাই সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের প্রায় ১০০ একর জমিতে ছাপড়া ও ঝুঁপড়ি ঘর নির্মাণ করে সাঁওতাল-বাঙালিরা। এরপর থেকে এসব ঘরে বসবাসসহ জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন তারা। বাকি জমিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ রোপন করে।

 

২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আখ কাটা নিয়ে পুলিশসহ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ বাঁধে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন সাঁওতাল নিহত ও উভয় পক্ষের কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়।

ওই দিন সন্ধ্যার দিকে ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে পুলিশ-প্রশাসন।

চার বছর আগে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে হামলা প্রতিহতের চেষ্টায় সাঁওতালরা

 

সেই হামলার ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে থমাস হেমব্রম ওই বছরের ২৬ নভেম্বর ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে ৫০০ থেকে ৬০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

তদন্ত শেষে ৯০ জনকে অভিযুক্ত করে ২০১৯ সালের ২৮ জুন গোবিন্দগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

কিন্তু ‘প্রকৃত দোষীদের’ বাদ দেয়ার অভিযোগে সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে নারাজি দেন বাদী থমাস হেমব্রম। পরে আদালতের নির্দেশে মামলাটি সিআইডির কাছে যায়।

সাঁওতালদের মামলায় যা ছিল

থমাস হেমব্রমের মামলায় বলা হয়, গাইবান্ধা- ৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আওয়াল, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আব্দুল হান্নান ও খামারের ব্যবস্থাপক আব্দুল মজিদের নির্দেশনায় সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল ও কাটাবারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিকসহ মিলের শ্রমিক ও পুলিশ হামলা চালায় সাঁওতালদের ওপর।

এ সময় ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন শ্যামল হেমব্রম, রমেশ টুডু ও মঙ্গল মার্ডি।

 

থমাস হেমব্রম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূল ১১ আসামিকে বাদ দিয়ে পিবিআই ৯০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। সেটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতিত্বে ভরা। এ কারণে নারাজি দিয়ে আবার তদন্তের দাবি করি। পরে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য সিআইডিকে দায়িত্ব দেয় আদালত।’

তিনি বলেন, ‘আমার তিন ভাইকে গুলি করে মারা হলো। জ্বালিয়ে দেয়া হলো ঘর-বাড়িসহ ক্ষেতের ফসল। আমরা আমাদের বাপ-দাদার জমি ফেরতসহ প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানাই।’

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লির বর্তমান চিত্র

 

সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে বলেন, ‘প্রকৃত আসামিদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন করে চার্জশিট দেয়া হোক।’

জমি দখলের বিষয়টি অস্বীকার করে ফিলিমন বাস্কে বলেন, ‘অধিগ্রহণ করা কিছু জমিতে বাড়ি-ঘর নির্মাণসহ ধান-কলাই চাষাবাদ ও পতিত জমি গোচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাপ-দাদার জমিতে এটা আমার অধিকার।’

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রামকৃষ্ণ বর্মন নিউজবাংলাকে জানান, সাঁওতালদের জীবনমান উন্নয়নে রাস্তা, বিদ্যুৎ ও গুচ্ছগ্রাম করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য কর্মসূচির আওতায় তাদের আনা হচ্ছে।

মামলায় ২৫ আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় লুট করা একটি পাওয়ার টিলার, দুটি শ্যালো মেশিন, একটি ভ্যান ও ৫৬টি ঢেউটিন।

আসামিদের মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের সারাই গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে মিঠু মিয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আদালতে।

পুলিশের মামলা

হামলা, হত্যার পর পুলিশ উল্টো তাদের ওপর হামলার অভিযোগে সাঁওতাল-বাঙালিদের বিরুদ্ধে মামলা করে। সেই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে পিবিআই।

প্রতিবেদনে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলীসহ ৪২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

এ মামলায় গ্রেফতার চার জন বর্তমানে জামিনে। তিন জন মারা গেছেন।

এ বিভাগের আরো খবর