গুজব ছড়িয়ে স্কুল থেকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় বের করে দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যা। কারা জড়িত তা স্পষ্ট ভিডিওতে। আসামিরা ধরাও পড়ে দ্রুত। তবে দেড় বছরেও বিচার শুরু হয়নি।
তসলিমা বেগম রেনু ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। চাকরি করেছেন আড়ং, ব্র্যাকে। শিক্ষকতা করেছেন স্কুলেও। ২০১৭ সালে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মায়ের সঙ্গে মহাখালী ওয়্যারলেস গেটের একটি ভাড়া বাসায় দুই সন্তান নিয়ে থাকছিলেন।
বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মাও চলে গেছে চিরদিনের জন্য। শিশু দুটির জীবন হয়ে গেছে কঠিন। বিচার পাওয়ার যে সান্ত্বনা, সেটিও নেই পরিবারে।
সম্প্রতি লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে একজনকে পিটিয়ে হত্যার পর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মরদেহ। নির্মম এই ঘটনায় দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।
তবে অতীতে একই ধরনের নানা ঘটনায় করা মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হয়নি বললেই চলে। আলোচিত কিছু ঘটনাতেও কাউকে সাজার মুখোমুখি হতে হয়নি। মামলা হলেও নানা জটিলতায় আটকে গেছে বিচার।
পুলিশ সদরদফতরের হিসাবে ২০১৯ সালে সারা দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছে ৬৫ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩০ জন প্রাণ হারিয়েছে।
রেনু হত্যার প্রধান আসামি মো. ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা
পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে বলে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ জুলাই উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তসলিমা বেগম রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এই ঘটনার ভিডিও ছড়ায় ফেসবুকে। তোলপাড় হলে তৎপর হয় পুলিশ।
- আরও পড়ুন: নাসিরনগরে হামলাকারীদের কিছুই হয়নি
রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটো তখন অজ্ঞাত পাঁচশ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তদন্তে নামেন বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক।
পুলিশ ১২ জনকে আটক করে গ্রেফতার করে এই মামলায়। প্রধান সন্দেহভাজন মো. ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লাসহ চার জন আদালতে জবানবন্দি দেন।
রাজ্জাক জানান, তারা তদন্ত প্রায় চূড়ান্ত করার পর গত বছর অক্টোবর মাসে তদন্তের দায়িত্ব নেয় ডিবি। এরও প্রায় এক বছর পর আদালতে জমা দেয়া হয় অভিযোগপত্র।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয়।
এক বছর ধরে চলা নতুন তদন্তে নতুন করে সাত জনকে চিহ্নিত ও দুই জনকে গ্রেফতার করে ডিবি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণসংযোগ বিভাগের উপ কমিশনার ওয়ালিদ হোসেন জানান, চার জনের পূর্ণাঙ্গ নাম ও ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তাই তাদের নাম অভিযোগপত্রে যুক্ত করা হয়নি। তাদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ বা গ্রেফতার করা গেলে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামি করা হবে।
ওয়ালিদ হোসেন জানান, তারা যাদের আসামি করেছেন, তাদের মধ্যে দুই জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। আর পলাতক দেখানো হয়েছে মো. মহিউদ্দিনকে।
সব যখন স্পষ্ট, তখন তদন্তে এত সময় কেন লাগল- এমন প্রশ্নে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর আব্দুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এতদিনে সবকিছু ঠিকঠাক তদন্ত করে ডিটেইল জমা দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অভিযোগপত্র জমা দিয়ে দিয়েছি। আর এখন আমাদের হাতে আর কিছু করার নেই। যা করার আদালত করবে।
মামলার বাদী সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটো জানান, ২ অক্টোবর অভিযোগপত্র ও তদন্ত প্রতিবেদন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে জমা পড়েছে। তবে শুনানির তারিখ পড়েনি।
টিটো বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশের কাছে তদন্তভার চলে যাওয়ার পর বেশ ধীর গতি দেখা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তারা অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদন আমাদের মনমতো হয়নি। তবু আমরা মেনে নিয়েছি। বিচার দ্রুত হোক। আমার খালার খুনিরা সাজা পাক।’
এই বিলম্বে পুরোপুরি হতাশ টিটো। বলেন, ‘আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি যথেষ্ট হেল্প করেছেন। এখন আইন মন্ত্রীর কাছে যাব, মামলাটি যেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয়।’
আসামিদের মধ্যে ওয়াসিম, হৃদয় ও রিয়া বেগম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এদের মধ্যে রিয়া বেগম, বাচ্চু মিয়া, শাহীন, মুরাদ ও বাপ্পি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
রেনুর দুটি সন্তান। বড়টি ছেলে, বয়স ১২। ছোটটি মেয়ে, বয়স পাঁচ।
টিটো বলেন. ‘ছেলে-মেয়ে দুটি বারবার তাদের মায়ের কথা বলে। কী জবাব দেব বলেন? কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেই। ছোট্ট মন, কখনও মানে, কখনও কাঁদে।’
টিটো জানান, শিশু দুটি কেবল ভয় পায়। তাই তাদের পাশে থাকতে তিনি ইউনিলিভারের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।
‘এখন ছোটখাটো কন্সালটেন্সি করি। বাচ্চা দুজনকে দেখাশোনার কাজ আমারই করতে হয়। বিচারটা হলে মনটা মানাতে পারতাম। কিন্তু সেটা কবে?’
‘খালার হত্যা মামলাটির বিচারের মাধ্যমে সমাজের কাছে কিছু বার্তা দেয়া জরুরি। মানুষকে বোঝাতে হবে আইন হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ মানুষের নেই ‘
বাংলাদেশ ও ভারতে গণপিটুনির ধরন ও প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজীব নন্দী৷
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজীব নন্দী
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন করব না। তবে যদি যথাসময়ে বিচার না হয় তবে গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকবে।’
কেন বিচার হচ্ছে না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘গবেষক হিসেবে বলতে পারি, গণপিটুনি হওয়ার পর সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী বা সাক্ষী না পাওয়ার কারণে ভারত ও বাংলাদেশে বিচার প্রক্রিয়াটা আগায় না। শুধু তাই নয় এটার পাশাপাশি সঠিক তদন্ত হয় কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।’
এই গবেষকের মতে, গণপিটুনি বন্ধ হওয়ার তিনটি পথ রয়েছে।
১. আমাদের দীর্ঘমেয়াদী সুশাসনের দিকে যেতে হবে।
২. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা থাকতে হবে। আগে মানুষ পিটিয়ে পুলিশে দিত। এখন দেখা যাচ্ছে পিটানোর পর মানুষ পুড়িয়েও ফেলছে। নিশ্চয়ই পুলিশের ওপর তার ওই আস্থাটা আর নেই বলেই সে নিজেই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।
৩. রাজনীতিবিদদের উদ্যোগ নিতে হবে। সামাজিক সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।
আলোচিত ঘটনারও বিচার হয়নি
২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে সাভারের আমিন বাজারে ছয় কলেজ ছাত্রকে ডাকাত সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। নয় বছরেও এটি রায়ের পর্যায়ে যায়নি।
মামলাটি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের বিচারক কামরুন্নাহারের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার ও শতাধিক বসতঘরে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়।
২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হামলার বিচার শুরু হয়নি এখনও। ছবি: নিউজবাংলা
এই ঘটনায় করা ১৮টি মামলার একটিও শেষ হয়নি এখনও। সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে উল্টো মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর বেপরোয়া হামলার ঘটনায় আটটি মামলা হয়। এর মধ্যে একটির প্রতিবেদন কেবল জমা পড়েছে। বাকি সাতটির তদন্তই শেষ হয়নি এখনো।