করোনা মহামারিতে গোটা পৃথিবীর মানুষের হাঁসফাঁস জীবন। তবে বন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রে চিত্রটি ভিন্ন। বিশেষ করে চিড়িয়াখানায় বন্দি প্রাণীদের জন্য নিরিবিলি সময়টি কেটেছে আয়েশি মুডে।
ঢাকায় দর্শনার্থীদের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার দরজা বন্ধ হয় ২০ মার্চ। সাত মাস পর নানান স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সেই দরজা খুলেছে গত রোববার।
দর্শকহীন এই সাত মাস চিড়িয়াখানায় বেশ ভালোই কেটেছে প্রাণীদের। নিজেদের মতো করে পাওয়া অবকাশে আরো প্রাণবন্ত হয়েছে প্রাণীরা। নির্বিবাদ পরিবেশে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর ১১৬টি শাবক।
চিত্রা হরিণের ১৮টি, গাধা ও জলহস্তির দুটি করে, ইম্পালা, জিরাফ, ঘোড়া ও মায়া হরিণের একটি করে শাবক দেখেছে পৃথিবীর আলো।
এছাড়া ময়ূর, ঘুঘু, বকসহ বেশকিছু পাখির ছানা জন্ম নিয়েছে এ সময়ে। সব মিলিয়ে করোনার আগে চিড়িয়াখানায় প্রাণী ছিল ২৭০০টি। আর এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৮১৬টি।
আগামী দুই মাসে আরো প্রায় ৫০টি শাবকের জন্মের অপেক্ষায় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনায় বন্ধ চিড়িয়াখানায় পশুপাখির প্রজনন হার ছিল অনেক বেশি। এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর ড. মো. আব্দুল লতিফ।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা যতই সচেতনতা বাড়াই, তারপরেও কিছু দর্শক আছে যারা পশুকে অযাচিতভাবে উত্ত্যক্ত করে, ঢিল ছোড়ে, খাবার দেয়। এগুলো এই সাত মাস ছিল না। এ জন্য আমরা পশুপাখিদের প্রতি মনোযোগ বেশি দিতে পেরেছি। ব্যালেন্সড ফিড দিয়েছি। সে কারণে ওদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে গেছে। আর বাড়তি আরাম আয়েশের জন্য তাদের প্রজনন ক্ষমতাও বেড়ে গেছে।’
প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ড. এম এ জলিল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চিড়িয়াখানার যাত্রা শুরুর পর থেকে এত লম্বা সময় কোনোদিন বন্ধ থাকেনি। মানুষ ভিড় করে নাই, বিরক্ত করে নাই। প্রাণীরা খাবার, পুষ্টি, সেবা সব পেয়েছে। আমরাও সর্বোচ্চ শ্রম দিয়েছি ওদের পেছনে।’
দর্শকহীন চিড়িয়াখানা প্রাণীরা কেমন উপভোগ করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দর্শনার্থী না থাকলে চিড়িয়াখানা জমজমাট থাকে না। তবে আমার পশুপাখিগুলো কিন্তু খুব ভালো ছিল। তারা হলিডে মুডে ছিল পুরোটা সময়।’
জলসুন্দরী, জলনুপূর, টিটু, ডায়না, দুরন্ত, টুনটুনি নামের জলহস্তিদের দেখভালকারী নুর এ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাত মাস নিরিবিলি পরিবেশে প্রাণীরা ছুটি পাইছে, তয় আমরা পাই নাই। এই সাত মাসে জলহস্তির দুইটা বাচ্চা হইছে। ওদের নাম এহোনো দেয়া হয় নাই।’
করোনার বন্ধে অনেক প্রাণীর শাবক এলেও চিড়িয়াখানার সাপেরা তেমন বাড়েনি। এর দায় অতিবৃষ্টির।
সরীসৃপ তদারকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাপ ডিম দিয়েছিল, কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টির জন্য ডিম মিস হয়েছে।’
তিনি জানান, চিড়িয়াখানায় এখন অজগর, গোখরা, দারাজ ও শঙ্খীনী এই চার প্রজাতির সাপ আছে। সামনে লাউডগা সাপ আনার পরিকল্পনা আছে।
নতুন প্রাণী সংগ্রহের ব্যাপারে চিড়িয়াখানার কিউরেটর বলেন, ‘মানুষ একই প্রাণী দেখে বিরক্ত হয়ে যায়। তাই বিদেশ থেকে কালো ভল্লুক, লাল ক্যাঙ্গারু, সিংহসহ আট রকমের প্রাণী আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে কোভিড ১৯ এর কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কার্যাদেশ দেয়া যাচ্ছে না।’
চিড়িয়াখানায় স্বাস্থ্যবিধি
১ নভেম্বর খোলার পর দর্শনার্থীদের জন্য ‘নো মাস্ক নো এন্ট্রি’ নিয়ম চালু করেছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। প্রবেশমুখে রয়েছে থার্মাল স্ক্যানার, ফুটবাথ, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ কড়া নজরদারি।
জনসচেতনতার জন্য স্বেচ্ছাসেবীরাও কাজ করছেন।
চিড়িয়াখানার কিউরেটর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কিছু পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছেন যারা দর্শনার্থীদের সচেতন করতে স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব পালন করছেন। এ জন্য তাদের বাড়তি কোনো অর্থ দেয়া হচ্ছে না।’
গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের এক চিড়িয়াখানায় একটি বাঘের শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে।
বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণীদের করোনা থেকে সুরক্ষিত রাখতে গত সাত মাসে কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল জানতে চাইলে কিউরেটর আব্দুল লতিফ বলেন, ‘এখানে করোনা ঢোকার মতো উপায় ছিল না। করোনা উপসর্গ নিয়ে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ঢুকতে পারেরনি, ফলে সব পশু সুস্থ ছিল।
‘পশুর মাঝে করোনার উপসর্গ দেখা দিলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা সব সময় প্রস্তুত।’