চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ গেছে ১৮৩ জনের। জুলাই মাসের শেষ দিন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। আলোচিত এ হত্যার পর প্রায় থেমেই গেছে এ ধরনের ঘটনা। গত তিন মাসে নিহতের সংখ্যা দুই।
‘বন্দুকযুদ্ধ’ কমার কারণ জানতে কথা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম না প্রকাশের শর্তে নিউজবাংলাকে তারা বলেন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার ঘটনার পর অনেকটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ কারণে বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় এপিবিএনের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা।
এরপর গত তিন মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই জন মারা গেলেও এর পেছনে অপরাধ কমার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা নিশ্চিত করতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ।
এ বিষয়ে কথা হয় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদের সঙ্গে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বড় একটা ঘটনার পর স্বভাবত একটা অস্বস্তি, ভীতি সবার মধ্যে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে একটু স্লো যাই, সাবধানে চলি- অবস্থা বিরাজ করছে বলে আমার ধারণা, যাতে আবার একই ধরনের ঘটনা না ঘটে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ১৮৪ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২১, ফেব্রুয়ারিতে ২২, মার্চে ২৫, এপ্রিলে ১৫, মে ও জুন মাসে ২৭ জন করে এবং জুলাই মাসে ৪৭ জন নিহত হয়।
৩১ জুলাই কক্সবাজারের ঘটনার পর ২ আগস্ট সিলেটের সুলতানপুরের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ‘মাদক কারবারি’ আবদুল মান্নান। এরপর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশের কোথাও ‘বন্দুকযুদ্ধের’ খবর পাওয়া যায়নি। সবশেষ ২১ অক্টোবর ভোরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন আরেক ‘মাদক কারবারি’।
আগস্ট ও অক্টোবরের এই দুটি ঘটনার বাইরে গত তিন মাসে আর কোথাও ‘বন্দুকযুদ্ধের’ খবর পাওয়া যায়নি। এই অবস্থাকে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘সাময়িক অবস্থান’ বলে মনে করছেন আসকের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু সময় অপেক্ষা করা দরকার। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে সরে আসতে চাচ্ছে।
‘কারণ সিনহা হত্যার পর জনগণের ভেতর ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে এবং বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর ভেতরও প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ কারণে বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে সাময়িক এই অবস্থান বলে আমার মনে হচ্ছে। সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আর ঘটাবে না, এটা বলার সময় এখনো আসেনি।’
সরকার চাইলে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ রাখতে পারে বলে মনে করেন আসকের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান।
তিনি বলেন, ‘এই স্থিতি অবস্থার মধ্য দিয়ে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সরকার চাইলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে পারে। আবার সরকার চাইলে এ ধরনের ঘটনা চলমান রাখতে পারে। এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রের নীতির উপর নির্ভর করে এবং যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাদের মন-মেজাজের ওপর নির্ভর করে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরও পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করলে এবং তাদের কাজের যথাযথ তদারকি থাকলে বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনা কমানো সম্ভব বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক প্রধান নূর মোহাম্মদ।
তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণত দেখি, অস্ত্র বা আইন যার হাতে থাকে, তাদের মাধ্যমে কিছু ঘটনায় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। এই বাড়াবাড়িটা যাতে না হয় এবং পেশাদারত্বের ঘাটতি যাতে না হয়, সে জন্য প্রপার সুপারভিশনের দরকার। প্রপার সুপারভিশনটা থাকলে এ ধরনের বাড়াবাড়ির ঘটনা কমে আসে।’
কথিত বন্দুকযুদ্ধে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে হত্যার পর টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ ১ হাজার ৫০৭ জন পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়েছে। বলা যায় কক্সবাজার পুলিশকে ঢেলে সাজানো হয়েছে।
মেজর সিনহা হত্যা মামলায় গ্রেফতার টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপসহ ১৪ জন এখন কারাগারে।