বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সরেজমিন: কোরআন শরিফে চুমুও খেয়েছিলেন শহীদুন্নবী

  •    
  • ১ নভেম্বর, ২০২০ ০১:২৮

ডেকোরেটর ব্যবসায়ী আবুল হোসেন মসজিদে ঢুকে শহীদুন্নবীকে মারপিট শুরু করেন। হোসেনের ডাকে বাইরে থেকে আরও কয়েকজন আসেন মসজিদে। এক পর্যায়ে শহীদুন্নবীকে টেনেহিঁচড়ে মসজিদের সিঁড়িতে নিয়ে বসান হোসেন।

ঢাকা থেকে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে পৌঁছাই শুক্রবার গভীর রাতে। শনিবার সকাল সকাল ভাড়া করা মোটর বাইকে পাটগ্রাম থেকে সীমান্ত বন্দর বুড়িমারীর দিকে যাত্রা শুরু। শহর পেরোতেই ধরলা পাড় থেকে দূরের চকচকে কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহিনী রূপ।

হিমালয় পাদদেশে শান্ত এই জনপদ বুড়িমারী নৃশংস এক ঘটনায় এখন সারা দেশে আলোচিত। পথের দুপাশের সারি সারি পাথর ভাঙার কল দেখে নিষ্ঠুর কিছু মানুষের পাথুরে হৃদয়ের কথাই বারবার মনে ভেসে উঠছে। একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেয়া কতটা অমানবিক!

বুড়িমারী বাজারে যখন পৌঁছাই, ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৯টা। ইউপি পরিষদ ভবনের বিধ্বস্ত চেহারা মন ভারী করে তোলে। এর ৩০ গজ দূরেই সেই আলোচিত বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। দারুণ সৌম্য, সুন্দর, নান্দনিক মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে গিয়ে ‘ধর্ম অবমাননা’র অভিযোগে হত্যার শিকার হন শহীদুন্নবী জুয়েল।

 

মসজিদে কথা হয় খাদেম জুবেদ আলীর সঙ্গে। শহীদুন্নবীর সঙ্গে প্রথম কথা কাটাকাটি হয় এই জুবেদ আলীর।

সেদিন শহীদুন্নবী কি কোরআন অবমাননা করেছিলেন- জানতে চাই তার কাছে। 

লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারীতে শহীদুন্নবীর ওপর হামলার সময়ের দৃশ্য। ছবি: নিউজবাংলা

 

জবাবে তিনি বলেন, ‘না এমন কিছু ঘটে নাই। তিনি (শহীদুন্নবী) মসজিদের র‌্যাকে পা রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তার পাশে কোরআন শরিফ ছিল। তিনি দেখতে পেয়ে কোরআন শরিফে চুমুও খেয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকজন মুসল্লি এটা নিয়ে বিতণ্ডা বাধান।’

জুবেদ আলি জানান, একপর্যায়ে সেখানে যান আবুল হোসেন। তিনি বুড়িমারী বাজারের হোসেন ডেকোরেটরের মালিক। লোকে ডেকোরেটর হোসেন নামে চেনে।

 

জুবেদ আলী বলেন, ‘হোসেন মসজিদে ঢুকে শহীদুন্নবীকে মারপিট শুরু করেন। হোসেনের ডাকে বাইরে থেকে আরও কয়েকজন আসেন মসজিদে। এক পর্যায়ে শহীদুন্নবীকে টেনেহিঁচড়ে মসজিদের সিঁড়িতে নিয়ে বসান হোসেন।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা নিউজবাংলাকে জানান, এরপর সেখানে আসেন মেম্বার হাফিজুল ইসলাম। তিনি হোসেনকে বের করে দেন। তবে উত্তেজিত হোসেন আলি বাজারের ভেতরে গিয়ে প্রচার করতে থাকেন, শহীদুন্নবী কোরআন পদদলিত করেছেন।

এ সময় মসজিদ কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রধান, সেক্রেটারি রেজোয়ান হোসেন, রেজোয়ানের ছেলে রিয়াদ ও তার দুই ম্যানেজার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তারাও স্থানীয়দের মধ্যে গুজব ছড়ানোয় যোগ দেন।  

 

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বাবুল আমাকে বলছিলেন সেদিনের কথা। তিনি বলেন, ‘ঘটনার পেছনে কী বা কারা আছে তা হয়ত তদন্তের পর জানা যাবে। কিন্তু একটা কাজে ওই সময় বুড়িমারী গিয়েছিলাম। তখন মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি আমাকে বলেন একজন মসজিদে গিয়ে কোরআন ছিড়ে পদদলিত করেছে। সে সময় তাদের বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।’

পাটগ্রামের ইউএনও কামরুন নাহারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে। ছবি: নিউজবাংলা

 

বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাইদ নেওয়াজ নিশাত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেসব মানুষ হামলায় অংশ নিয়েছে, তাদের বেশিরভাগকেই আমি চিনি না। কারণ এরা বহিরাগত। এরা স্থল পোর্ট ও পাথর শ্রমিকও হতে পারে। এখানে হাজার হাজার পাথর শ্রমিক কাজ করে। আসরের টাইমে কাজ শেষ হয়। ঘটনা আসরের পর হওয়ায় এরাও বিক্ষোভে অংশ নেয়।’

উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুল বলেন, “আমরা কিন্তু সেদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবার’ এবং ‘আল কোরআনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’ স্লোগান আসতে থাকে, তখনই ইউএনওসহ সবাইকে বলি, এটা ২০১৪ সালের মতো ঘটনা। সামলানো যাবে না। তখন ইউএনও আমাকে ঘরে যেতে বলেন। কিন্তু আমি বলি দেখি। এরপর মাগরিবের আজান হলো, মানুষ বাড়তে থাকল। স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকল। তখন আমরা ভিতরে গিয়ে কলাপসিবল আটকায়ে দেই।”

পাটগ্রামের ইউএনও কামরুন নাহারের কাছে জানতে চাই, এত সময় নেয়া হলো, অথচ রোষানল থেকে শহীদুন্নবীকে কেন বাঁচানো গেল না?

তিনি বলেন, ‘সময় আসলে বেশি নেয়া হয়নি। জনবল দিয়ে জনরোষ থামাতে হয়। আমার এত জনবল নেই। অন্য উপজেলা থেকে আনতেও তো সময় লাগে।’

 

বৃহস্পতিবারের ঘটনায় শনিবার পর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে, আসামিরা সনাক্ত হচ্ছে, ছয়জন আটকও হয়েছেন। তারপরেও সেদিনের ঘটনার জট এখনো সেভাবে খোলেনি, কেন?

পাটগ্রাম থানায় ওসির কক্ষে এ বিষয়ে কথা হয় লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানার সঙ্গে।

তার মনেও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। পুলিশ সুপার বলেন, ‘যে মসজিদে ঘটনা, সেখানকার সভাপতি, সেক্রেটারি ঘটনাস্থলে ছিলেন। শুনেছি তারা বুড়িমারী বাজার ও এলাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা থাকতে এটা কীভাবে হয়! তারা হাত উঠালেই তো সবার থেমে যাওয়ার কথা।’

রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্যের কাছে প্রশ্ন ছিল, বৃহস্পতিবারের ঘটনায় মৌলবাদী শক্তির কোনো ইন্ধন ছিল কিনা?

তিনি বলেন, ‘এটা তদন্ত সাপেক্ষ বিষয়।’

অল্প সময়ের মধ্যে এত মানুষ জড়ো হওয়া, জনপ্রতিনিধি ও সমাজ পরিচালকদের সামনে ঘটনাটি ঘটায় এর পেছনে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তিনি।

সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হাফিজুল ইসলাম। বুড়িমারী বাজারে কথা হয় তার সঙ্গে।

প্রাণ হারানোর আগে প্রায় দুই ঘণ্টা হাফিজুলের তত্ত্বাবধানে ছিলেন শহীদুন্নবী।

রংপুরে শহিদুন্নবীর গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন অনেকেই। ছবি: নিউজবাংলা

 

হাফিজুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে হোসেন আলি কল করে মসজিদে আনে। এসে দেখি শহীদুন্নবীর সঙ্গী (সুলতান জোবায়ের আব্বাস) হতভম্ভ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। এর আগে তিনি প্রচণ্ড মার খেয়েছেন। ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না। কয়েকবার কী হয়েছে জানতে চাইলে, তিনি কেবল বলেন- আমরা নামাজ পড়েছি। এরপর উনি কী করলেন, আমাদের মারা শুরু করল এরা।’

‘এরপর তার (জোবায়ের) হাত ধরে টেনে আসেন বলে নিয়ে যাই ওজুঘরের ওখানে। সেখানে শহীদুন্নবীকে দেখি হাউজ থেকে দুই হাতে পানি নিয়ে মাথায় দিচ্ছেন। তার মাথায় বড় আঘাতের চিহ্ন। ক্ষতস্থান লাল ও ফোলা। এ সময়েও শহীদুন্নবীকে পেটাচ্ছিল একদল মানুষ। আমি সবাইকে বলি সে দোষ করলে প্রশাসনের হাতে তুলে দেব। কিন্তু কোনো অঘটন ঘটতে দেয়া যাবে না। এই বলে দুজনকে ধরে নিয়ে আড়াআড়ি মার্কেটের মধ্য দিয়ে ৫০ গজ দূরের ইউপি ভবনে যাই। পেছনে পেছনে কয়েকশ মানুষও আমাদের সঙ্গে যায়।’

হাফিজুল বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে গিয়ে ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ওসিসহ সবাইকে  ফোন করি।  তারা অনেকেই সেদিন,  সেই সময় বুড়িমারীতে ছিলেন। তারা ইউপি চত্ত্বরে প্রবেশের পরপরই কী হলো, বুঝতে পারলাম না। প্রশাসনের লোক দেখেই সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। নারায়ে তকবির স্লোগান দিতে থাকে। তারা ইট পাটকেল, এমনকি বালু পর্যন্ত ছুড়তে করতে থাকে। সবাই দলবদ্ধভাবে গ্রিল টেনে দেয়ালসহ ভেঙে ফেলে।’

 

বুড়িমারীর বাসিন্দা ও পাটগ্রাম মহিলা কলেজের প্রভাষক শফিকুল ইসলাম সেদিনের উন্মত্ততার বর্ণনা দেন।

ভারী কণ্ঠে আমাকে বলেন, ‘তারা একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরেই কেবল থামল না, গলায় ও পায়ে রশি বেঁধে টানতে টানতে ৩০০ মিটার দূরের বাঁশকল এলাকায় নিয়ে গেল। এরপর শরীরে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দিলো। মৃত দেহ টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়েও তারা আঘাত করছিল।’

শহীদুন্নবীর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার গুজব প্রথম যিনি ছড়ান, সেই আবুল হোসেনের বাড়িতে শনিবার রাতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি বা পরিবারের সদস্যরা কোথায় আছেন সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি এলাকাবাসী।

এ বিভাগের আরো খবর