চারটি বছর পেরিয়ে গেছে, এখনও তদন্তই শেষ করতে পারেনি পুলিশ। নাসিরনগর হামলার বিচার আদৌ হবে কি না, এ নিয়েই শঙ্কায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।
অথচ দেশজুড়ে তোলপাড় করা হামলার পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, পার পাবে না কেউ।
এই ঘটনায় মোট মামলা হয়েছিল আটটি। কেবল একটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। সেটিরও বিচার শুরু হয়নি এখনও। আর সাতটি মামলার তদন্ত কবে শেষ হবে সেটিও নিশ্চিত নয়।
মামলাগুলোর তদন্তের ভার নাসিরনগর থানার পরিদর্শক তদন্ত কবির হোসেনের কাছে। তবে তার কাছে জবাব নেই।
নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিচুর রহমান বলেন, ‘মামলাগুলোর তদন্ত শেষ পর্যায়ে। যাচাই-বাছাই শেষে দ্রুত আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) রইছ উদ্দিন বলেন, ‘খুবই যত্ন সহকারে মামলাগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে। যাতে কোনো প্রকৃত আসামি মামলা থেকে বাদ না পড়ে আর কোনো নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হয়।’
ফেসবুকে বানোয়াট একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরের হিন্দু পল্লীতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।হামলার পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার আশ্বাস দেয়া হয়েছে কঠোর শাস্তির। ক্ষমতাসীন জোট ১৪ দল নাসিরনগরে সমাবেশ করেও জানিয়ে এসেছে একই অঙ্গীকার। ঘটনার পর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারাও ছুটে গেছেন এলাকায়।
সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। ভেঙে দেয়া ঘরগুলো পুনর্নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু মনের ক্ষতের উপশম হয়নি।
বিচার হয়নি, আসামিরা প্রায় সবাই জামিনে মুক্ত। বিচার আদৌ হবে কি না জানা নেই কারও।
চার বছর আগের ২৭ অক্টোবর ফেসবুকে পোস্টটি দেয়া হয়েছিল নিরক্ষর জেলে রসরাজ দাসের নামে খোলা আইডিতে। পরে জানা যায়, স্মার্টফোন তিনি চালাতেই পারেন না।
হামলার পর প্রাথমিক তদন্তের আগেই ২৯ অক্টোবর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের মামলায় রসরাজকে আটক করে পুলিশ।
এই জেলের শাস্তির দাবিতে ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে সমাবেশ ডাকে দুটি ইসলামী সংগঠন। সেখান থেকেই ১০টি মন্দির ও শতাধিক ঘরবাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
হামলার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এর মধ্যে ৪ নভেম্বর ও ১৩ নভেম্বর আবার হামলা হয় হিন্দুদের অন্তত ছয়টি ঘর-বাড়িতে।
এই হামলায় পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্তদের করা আটটি মামলায় অজ্ঞাত দুই হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়। তখন হামলার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে ১২৫ জনকে গ্রেফতারও করা হয়। তবে তারা এখন আর কেউ আটক নন। জামিনে মুক্ত সবাই।
রসরাজের বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পান তিনি। বিনা দোষে বন্দি জীবন কাটানোয় কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।
রসরাজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি কিছতা (কিছু) করছি না, তেও আমারে জেলে যাওয়ন লাগল। অহনও ডর লাগে। বেশি রাইত কইরা আর মাছ ধরতে যাই না।’
ফেসবুক কে খুলে দিয়েছে জানতে চাইলে রসরাজ বলেন, ‘ফডো (ফটো) দেহনের লাইগ্যা চাচাতো ভাই হৃদয়রে কইছিলাম ফেসবুক খুইল্যা দিত। কিন্তুক হেইদিন (সেদিন) বেইন অক্ত (সকাল বেলা) মাছ ধইরা বাইত (বাড়ি) যাওনের সময় পুলাপান আমারে দইরা মাইর শুরু হরে। বাদে (পরে) আমারে পুলিশো দেয়।’
এই ঘটনায় একটি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে এক বছরের কিছু সময়ের মধ্যেই। ১৩ মাস পর ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর গৌরমন্দির ভাঙচুর মামলায় পুলিশ নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম ও হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখিসহ ২২৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। তবে অভিযোগ গঠন করে বিচার এখনও শুরু হয়নি।
গৌরমন্দিরের পূজা উদযাপন কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ভাঙচুর মামলার বাদী নির্মল চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সহিংসতার ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত। নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সবসময়ই ভালো ছিল। এই সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে চেয়েছিল কিছু দুষ্কৃতিকারী, যার ভুক্তভোগী হিন্দু-মুসলমান সবাই। হামলার পর পুলিশের কথায় বিচারের আশায় মামলা করেছিলাম। এরপর আর বিচারের কোনো লক্ষণ দেখছি না।’‘শুনেছি, বাকি সাতটি মামলার চার্জশিট এখনও দেয়া হয়নি। মামলাগুলোর সঠিক তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানাচ্ছি।’হামলা ও ভাঙচুরের শিকার উপজেলা সদরের গৌরমন্দির এলাকার বাসিন্দা স্বাধীন দাস বলেন, ‘আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনও মনে হলে আতঙ্ক কাজ করে। বিচার না হলে হামলাকারীরা আরও সাহস পেয়ে যাবে।’হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার হরিণবেড় গ্রামের বাসিন্দা বিমুল বিহারী চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু অনুদান দিলেও ভাই-ভাতিজাদের চিকিৎসার জন্য আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। আমরা এখন বিচার চাই, শান্তিতে বসবাস করতে চাই।’উপজেলা সদরের গাংকুলপাড়া এলাকার বাসিন্দা সঞ্জয় ঘোষ বলেন, ‘মাত্র একটি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। বাকিগুলো কেন হচ্ছে না?’
নাসিরনগর উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুজিত চক্রবর্তী বলেন, ‘নাসিরনগরের হামলার খলনায়কদের আইনের আওতায় আনলে পরে ভোলার ঘটনা ঘটত না।’