ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুলের জন্য বরাদ্দ জায়গা দখল করে পেট্রলপাম্প বানিয়েছেন সরকারদলীয় সাংসদ হাজী মোহাম্মদ সেলিম। এ নিয়ে মামলার রায়ে জায়গার অধিকার সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ জায়গাটির দখল ফিরে পায়নি।
শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসহ সার্বিক পুনর্বাসনে স্কুলভবন ও বধির কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ২০০৫ সালে বিশেষায়িত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে জায়গাটি বরাদ্দ দিয়েছিল ঢাকা জেলা প্রশাসন। এক একর আয়তনের এই জায়গাটির অবস্থান লালবাগের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কামালবাগ এলাকায়।
শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য দেশের একমাত্র সরকারি এ উচ্চবিদ্যালয়টি বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার প্রধান প্রকল্প। সম্প্রসারণের জন্য নতুন জায়গা না পেয়ে এখনও বিজয়নগরের অপরিসর জায়গায় স্কুলটির কার্যক্রম চলছে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ ও সংস্থার দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, ২০০৫ সালে পাঁচ লাখ টাকা প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ পাওয়ার পর পরবর্তী তিন বছর কামালবাগের জায়গাটি তাদের দখলে ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে হাজী সেলিমের লোকেরা জায়গাটির সীমানা খুঁটি উপড়ে ফেলে। সেখান থেকে স্কুলের লোকজনকে মেরে তাড়িয়ে দেয়।
স্কুল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, জায়গাটি ফিরে পেতে পরবর্তীতে দফায় দফায় তারা সাংসদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শিক্ষামন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিয়েছেন। এক পর্যায়ে জায়গা উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পাশাপাশি পালন করেছেন মানবন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনের মতো নানা কর্মসূচি।
জায়গার মালিকানা দাবি করে হাজী সেলিম ২০০৯ সালে আদালতে মামলা করেছিলেন। মামলার রায় স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষে গেলেও সাংসদ তা তোয়াক্কা করেননি।
পুরান ঢাকার আলোচিত রাজনৈতিক নেতা হাজী সেলিম আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই এলাকা থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ও ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার প্রতিষ্ঠান মদিনা গ্রুপের আবাসন, সিমেন্ট, পানির ট্যাংক, পাম্প, শিপিংসহ আরও নানা খাতে ব্যবসা রয়েছে।
পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের নিজের নামে জমি দখলের অভিযোগ পুরনো। তিনি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সরকারি জমি দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে বিআইডব্লিউটিএ অভিযান চালিয়ে সেই অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রবাস দখল করে মার্কেট নির্মাণের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। ছাত্রাবাস উদ্ধারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কয়েক বছর ধরে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। এ ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে নানা সময়ে সাংসদের বিরুদ্ধে সম্পত্তি দখলের অভিযোগ এনেছেন।
এদিকে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকায় হাজী সেলিম তাঁর স্ত্রীর নামে অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের একটা জমি দখল করেন। নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় হাজী সেলিমপুত্র ইরফান সেলিমকে গ্রেফতারের পর এই জমিটি উদ্ধার করে অগ্রণী ব্যাংক। মূলত এই ঘটনার পর থেকে হাজী সেলিম ও তাঁর ছেলের আরও অনেক দখলবাজির ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে।
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে স্ত্রীর নামে হাজী সেলিমের দখল করা প্রায় শত কোটি টাকার জমিটি সম্প্রতি দখলমুক্ত করা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
কামালবাগে ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুলের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া জায়গাটির মূল দলিল, বরাদ্দপত্র ও খাজনা আদায়ের রশিদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মহানগর জরিপ অনুসারে লালবাগ মৌজায় অবস্থিত এক একর আয়তনের এই জমির দাগ নম্বর ১৭০২৭। ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিন দফায় জেলা প্রশাসন জায়গাটির দখল স্কুল কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আর শুরু থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষই জমির খাজনা পরিশোধ করে আসছে।
লালবাগ শ্মশানঘাট এলাকা থেকে বেড়িবাঁধ ধরে এগিয়ে সোয়ারী ঘাটের আগে হাতের বাম পাশে স্কুলের জায়গা। সেখানে গড়ে তোলা পেট্রলপাম্পটির নাম ‘মদিনা ফিলিং স্টেশন’। স্থানীয়রা জানান, এখানে পেট্রল পাম্প গড়ে তোলা হয়েছে ২০১০ সালের পর। এ ছাড়া এর আশপাশে বেড়িবাঁধের কোল ঘেঁষে মদিনা গ্রুপের কোল্ড স্টোরেজ, সিমেন্টের গোডাউন, গৃহ নির্মাণ সামগ্রীর দোকানসহ আরও কিছু স্থাপনা চোখে পড়ে।
শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য ঢাকার বিজয়নগরে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি ১৯৮৪ সালে জুনিয়র হাইস্কুল হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়। মাধ্যমিক স্তরের স্বীকৃতি আসে এর ছয় বছর পর। সরকারিকরণ হয় ২০১৬ সালে।
মঙ্গলবার বিদ্যালয়টির বিজয়নগর প্রাঙ্গণে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, স্কুলটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে তিনশ। এর মধ্য আবাসিক শিক্ষার্থী আছে দেড় শ জনের মতো।
হতাশ কণ্ঠে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানে সারা দেশ থেকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা আসে। সবাই এই প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু জায়গার অভাবে আমরা সবাইকে নিতে পারি না। অতিরিক্ত চাপে এখানকার আবাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে প্রায়। ক্লাসেও জায়গা হয় না। অথচ এতদিনে আমাদের নতুন জায়গায়, নতুন কমপ্লেক্সে উঠে যাওয়ার কথা ছিল।’
কামালবাগের জায়গাটি নিজেদের দখলে নিতে সব রকমের প্রচেষ্টার কথা জানিয়ে এই শিক্ষক বলেন, ‘জেলা প্রশাসন আমাদের যতবার জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছে, ততবার এমপির (হাজী সেলিম) লোকজন আমাদের মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। দখল রাখার জন্য আমরা সেখানে একটা ছোট ঘর তুলতে চেয়েছিলাম। এ জন্য ট্রাকে করে যে ইট-বালি নিয়ে গেছি সেগুলোও কেড়ে নিয়েছে। আমরা কিছুতেই পেরে উঠিনি।’
একই কথা বলেন জাতীয় বধির সংস্থার সাবেক সভাপতি ও দলিলে স্কুলের পক্ষে জায়গাটির বন্দোবস্ত গ্রহীতা তৈমূর আলম খন্দকার। নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘জায়গা উদ্ধারের জন্য আমরা যাইনি এমন কোনো জায়গা নেই। কিন্তু সবখানে, সবাই হাজী সেলিমের নাম শুনলেই চুপসে যায়।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য হাজী সেলিমের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব মহিউদ্দীন মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমপি সাহেব এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।’
ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) শাহনাজ সুলতানা নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আমাদের কাছে আসুক। একটা আবেদন করুক। আমরা অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেব।’