ছেলে কারাগারে, দেখা নেই প্রতাপশালী বাবার। কোথায় হাজী মোহাম্মদ সেলিম? যে অভিযোগে ছেলে গ্রেফতার, তাতে দায় নেই বাবার। তবু লাপাত্তা তিনি।
বাড়িতে দিনভর র্যাবের অভিযান চলার সময় খুঁজেই পাওয়া গেল না আলোচিত এই রাজনীতিককে। এরপর পেরিয়ে গেল আরও দুটি দিন। কিন্তু দেখা নেই সেলিমের।
সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুরান ঢাকার দেবীদাস ঘাট লেনে হাজী সেলিমের নয় তলা ভবন ‘চাঁন সরদার দাদাবাড়ী’তে অভিযান চালায় র্যাব।
অভিযান শুরুর কিছুক্ষণ আগে স্ত্রীকে নিয়ে ভবন থেকে বেরিয়ে যান ঢাকা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হওয়া হাজী সেলিম। অভিযোগ নেই বলে হাজী সেলিমকে আর খোঁজেনি র্যাব।
হাজী সেলিমের এলাকা ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ইশতিয়াক মির্জা বলেন, ‘উনি বাসায় ফিরেছেন কি না আমার জানা নেই। কোথায় আছেন, সেটাও বলতে পারব না।’
হাজী সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী মোহাম্মদ সোহেলের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন কেটে দিয়ে এসএমএসে লেখেন, ‘আই উইল কল ব্যাক।’
পরে কল ফরওয়ার্ড করে রাখেন সোহেল।
সবাই ‘চুপ’
ছেলে ইরফান সেলিম গ্রেফতারের পর হাজী সেলিমের এলাকায় দাপট আর দখলদারিত্বের বিষয়টি নতুন করে উঠেছে। এবার জানা গেল, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের ভবন বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে দখল করেন হাজী সেলিম।
১৯৪৭ সাল থেকে তৎকালীন হাবীব ব্যাংকের জমিটি ২০০৩ সালে হঠাৎ করেই স্ত্রীর বলে দাবি করতে থাকেন হাজী সেলিম। একটি দলিলও হাজির করেন। ব্যাংক বলে, দলিল জাল।
স্পষ্টত হাজী সেলিম চাপে। তার পরেও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না তার নির্বাচনি এলাকার লোকজন।
হাজী সেলিমের বাড়ির পাশের এক দোকানির কাছে তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই আমার কাম আছে। আমি কিছু কইতে পারুম না।’
দলে হাজী সেলিমের প্রতিদ্বন্দ্বী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনও চুপ। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না।’
২০১৮ সালের নির্বাচনে হাজী সেলিমের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মোস্তফা মহসিন মন্টু।
তিনি বলেন, ‘তিনি (হাজী সেলিম) যখন আওয়ামী লীগে আসেন, তখন আমি আওয়ামী লীগে নেই। গত নির্বাচনের সময় আমার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল।যেহেতু আমার সঙ্গে উনার নির্বাচন হয়েছিল, তাই আমি কিছু বলতে পারব না। তাহলে মানুষ মনে করবে আমি বিষয়টি পারসোনালি নিয়েছি।’
তবে মুখ খুলতে না চাওয়ার ভিড়ে ব্যতিক্রম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি হিমেলুর রহমান হিমেল।
তিনি বলেন, ‘হাজী সেলিম সংসদ সদস্য হওয়ার আগে থেকেই পুরান ঢাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। তিনি ওই এলাকায় একটি ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেন।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি করেছি। তখন তিনি সংসদ সদস্য। তবে মাঝখানে মাঠ উদ্বোধন করতে গিয়ে উনার সঙ্গে আমার গণ্ডগোল হয়; উনি আমাকে মারধর করেন। আমি তখন বলেছি, উনি আমার এমপি, আমি উনাকে সম্মান করি। অসুবিধা কী, উনি আমাকে মারতেই পারেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এক নেতা বলেন, ‘উনার (হাজী সেলিম) কর্মকাণ্ডের বিষয়ে দলের হাইকমান্ড অলরেডি অবহিত আছে।’
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে হাজী সেলিম বিএনপির সমর্থনে ওয়ার্ড থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি সংসদ নির্বাচন করার ইচ্ছা পোষণ করেন। তবে বিএনপি মনোনয়ন দেয়নি। পরে চলে যান আওয়ামী লীগে। নৌকা প্রতীক নিয়ে বিএনপির আবুল হাসনাতকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সংসদ সদস্য থাকাকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হাজী সেলিমের ছবি ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে।
২০০১ সালে বিএনপির নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর কাছে হেরে যান সেলিম। ২০০৮ সালে তাকে আর মনোনয়ন দেয়নি দল। ২০১৪ সালে নৌকা না পেয়ে হন স্বতন্ত্র প্রার্থী। হারিয়ে দেন নৌকার মোস্তফা জালালকে।
২০১৬ সালে হাজী সেলিম আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আবার পান দলীয় প্রতীক। আবার হন সংসদ সদস্য।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, হাজী সেলিমের ছেলের প্রসঙ্গ আসার পর দল বিব্রত। তবে যেহেতু হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেনি, তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে না।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যারা অপরাধ করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ইরফানের বাবা যদি অপরাধ করেন তাহলে তার ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ক্ষমতাসীন দলের আরেক সাংগঠনিক সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘শেখ হাসিনার যত কাছের লোকই হোক, তিনি যদি অপরাধ করেন, রেহাই পাবেন না।’
আওয়ামী লীগের পরিবেশ ও বন সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘অপরাধ করলে শাস্তি পাবে এটাই আমাদের দল ও নেত্রীর সিদ্ধান্ত। এর বাস্তবায়ন হলো এই গ্রেফতার (হাজী সেলিমের ছেলে)।’