ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের রয়েছে ১২ জনের ক্যাডার বাহিনী, যাদের মাধ্যমে এলাকায় চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক আধিপত্য ও দখলের রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
ক্যাডার বাহিনীর সঙ্গে গোপন যোগাযোগের জন্য তার বাসায় স্থাপন করেছিলেন কন্ট্রোল রুম। এর অ্যান্টিনা ছিল বাসা থেকে হাঁটা দূরত্বে মদিনা আশিক টাওয়ারের ১৭তলা ভবনের ছাদে।
কন্ট্রোল রুমটিতে সিসি ক্যামেরার মনিটরসহ একটি ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি ডিভাইস) ছিল, যেটার সঙ্গে যুক্ত ছিল ৩৮টি ওয়াকিটকি।
- আরও পড়ুন: কী আছে সেলিমপুত্রের ‘টর্চার সেলে’
র্যাবের অভিযান সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছেন, ইরফান তার এই সশস্ত্র ১২ ক্যাডার নিয়ে এলাকায় চলাফেরা করতেন। এলাকার দখল ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে মদিনা আশিক টাওয়ারের ছাদে স্থাপন করেছিলেন টর্চার সেল।
ইরফানের ১২ সদস্যের ক্যাডারসহ নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও এলাকা নিয়ন্ত্রণে হাজী সেলিম পরিবারের রয়েছে ৩৫ জনের ক্যাডার বাহিনী।
কন্ট্রোল রুমটি দুই থেকে তিন বছর আগে স্থাপন করেন ইরফান। তিনি ঢাকা দক্ষিণের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার আগ থেকেই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্যাডারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
- আরও পড়ুন: কাউন্সিলর পদ হারালেন ইরফান সেলিম
ভিএইচএফ ডিভাইসটির মাধ্যমে চার কিলোমিটারের বেশি এলাকা জুড়ে ইরফান তার লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। ভিএইচএফ ব্যবহারের কারণে পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের এই যোগাযোগ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারত না। এই প্রযুক্তি দেশের বাইরে থেকে অবৈধভাবে আনা হয়েছিল, যা ব্যবহার করে ইরফান তার সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, প্রতি রাতে মাতাল হয়ে ইফরান ও তার সহযোগীরা রাস্তায় বের হতেন এবং ক্ষমতার প্রদর্শন করতেন। তার ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে স্থানীয়রা কিছু বলার সাহস পায়নি। তবে এখন অনেকে কথা বলছেন।
পুলিশের সহায়তায় জমি দখলের অভিযোগও পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। তবে ইরফান বাহিনীকে সহায়তার অভিযোগ অস্বীকার করেছে চকবাজার থানা পুলিশ।
ইরফানের টর্চার সেল ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য ছিল না। র্যাবের অভিযানের পরই আমরা জানতে পেরেছি।’
র্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানিয়েছেন, সোমবার তাদের অভিযানের পর ইরফান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ র্যাবের কাছে আসছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে ইরফান ও জাহিদের এক বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের জন্য আরও দুটি মামলা হবে।’
নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে প্রথমে আঘাত করেন জাহিদ
নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদ খানকে প্রথম মারধর শুরু করেন সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের দেহরক্ষী জাহিদুল ইসলাম জাহিদ। এরপর গাড়ি থেকে নেমে আসেন ইরফান, চালক মিজানুর রহমান এবং মদিনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু। তারাও ওয়াসিফকে মারধর ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন।
ধানমন্ডি থানা পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন এবি সিদ্দিক দিপু।
সোমবার মধ্যরাতে টাঙ্গাইল থেকে তাকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশের রমনা বিভাগ। মঙ্গলবার দিপুকে তিন দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ।
নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফকে হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আশফাক রাজীব হাসান বলেন, মূল আসামিসহ চারজনই গ্রেফতার আছে। দুইজন অন্য অপরাধে কারাগারে। তাদেরও রিমান্ডের আবেদন করেছি। বাকি দুজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে কলাবাগান সিগন্যাল সংলগ্ন স্থানে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ মারধরের শিকার হন। অভিযোগ ওঠে হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। প্রথমে ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি ও পরদিন সোমবার ইরফান সেলিমসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন ওয়াসিফ।
ঘটনার ৩২ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ, র্যাব ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে।
রোববার সন্ধ্যায় ওই ঘটনার পর হাজী সেলিমের গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঘ ১১-৫৭৩৬) জব্দ করা হয় এবং রাতেই গাড়ির চালক মিজানুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মিজানুরকে সোমবার আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত এক দিন মঞ্জুর করে।
সোমবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনে হাজী সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিট, র্যাব-৩ ও ১০ অভিযানে অংশ নেয়। সঙ্গে ছিলেন দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
- আরও পড়ুন: ডাক্তার দেখাতে গিয়ে লাপাত্তা হাজী সেলিম
অস্ত্র, মাদক, অবৈধ ওয়াকিটকিসহ ইরফান সেলিম ও তার সহযোগী জাহিদকে গ্রেফতার করে র্যাব। মাদক ও ওয়াকিটকি ব্যবহারের অপরাধে দুজনকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার মধ্যরাতে তাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
মামলায় আরেক আসামী এবি সিদ্দিক দিপুকে সোমবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে টাঙ্গাইল থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। মঙ্গলবার তাকে তিন দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকরাম আলী মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, মামলার এজাহারে উল্লেখ থাকা চারজনকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও কাউকে জড়িত পাওয়া গেলে আইনাননুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সোমবার অভিযানের সময় অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রাখার অপরাধে ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার রাতে আরও দুটি করে মোট চারটি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ।