ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের স্ত্রীর দখল থেকে প্রায় ২০ শতাংশ জমি উদ্ধার করেছে অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকাস্থ মৌলভীবাজার শাখা।
প্রায় শত কোটি টাকা বাজার মূল্যের জমিটি ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যাংকের মালিকানায়। তবে প্রায় দুই দশক ধরে জমিটি স্ত্রীর বলে দাবি করে আসছিলেন হাজী সেলিম।
পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের নিজের নামে জমি দখলের অভিযোগ পুরনো। বুড়িগঙ্গা তীরে তিনি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সরকারি জমি দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে বিআইডব্লিউটিএ অভিযান চালিয়ে সেই অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে।
সাবেক জগন্নাথ কলেজের একাধিক ছাত্রবাস হাজী সেলিমের দখলে বলেও অভিযোগ আছে। ছাত্রাবাস উদ্ধারের দাবিতে ছাত্ররা কয়েক বছর ধরে নানা কর্মসূচিও পালন করে আসছে।
ঢাকা সরকারি বধির হাই স্কুলের নামে বরাদ্দ করা জমিও হাজী সেলিম দখল করে নিয়েছেন বলে স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করছে। এ ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়ে আরও অনেক সম্পত্তি দখলের অভিযোগ পুরনো।
করোনা পরিস্থিতিতে স্ত্রীর নামে অগ্রণী ব্যাংকের জমিটি দখল করা হয় গত এপ্রিলে। বুলডোজার চালিয়ে জমিতে থাকা ভবন গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। তারা তুলে দেয় সীমানা প্রাচীরও।
হাজী সেলিমের স্ত্রীর নামে দখল করা জমিটির দখল বুঝে নিয়ে মালামাল সরানোতে ব্যস্ত অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ করা শ্রমিকরা
এই জমি নিয়ে আগে থেকেই মামলা ছিল অগ্রণী ব্যাংকের। এর মধ্যেই জমিটি দখল করার পর আরও অভিযোগ দেয় ব্যাংক। কিন্তু চকবাজার থানা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
যে এলাকায় হাজী সেলিমের লোকজন জমিটি দখল করেছিল, সেখানে প্রতি শতক জমির বাজার মূল্য চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা। ফলে এই জমিটির মূল্য ৮০ থেকে একশ কোটি টাকা।
নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় হাজী সেলিমপুত্র ইরফান সেলিমকে গ্রেফতারের পর এই জমিটি উদ্ধার করে অগ্রণী ব্যাংক।
সোমবার হাজী সেলিমের বাসায় র্যাবের অভিযানের সময় জমি উদ্ধারে নামেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
- আরও পড়ুন: কাউন্সিলর পদ হারালেন ইরফান সেলিম
মঙ্গলবার সকালে ব্যাংকের সংস্থাপন বিভাগ উপমহাব্যবস্থাপক নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দলও ঘটনাস্থলে যায়। ব্যাংকটির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. আসাদসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জমি মেপে মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মণ্ডলের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়।
বৈষ্ণব মণ্ডল জানান, ৭৮/১ মোলভীবাজারের জমিটি দেশ ভাগের পর থেকে হাবিব ব্যাংকের দখলে ছিল। দেশ স্বাধীনের পর তৎকালীন হাবিব ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক একত্রিক করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশে অগ্রণী ব্যাংক গঠন করা হয়। তখন ওই জমি অগ্রণী ব্যাংকের দখলে চলে আসে।
অগ্রণী ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মণ্ডল জানান, তাদের ৭০ বছরের জমি গত এপ্রিলে বেদখল হয়
অগ্রণী ব্যাংকের প্রথম এই শাখার উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তার একটি ব্যাংক হিসাবও ছিল।
পুরনো ওই ভবনে ব্যাংকের কার্যক্রম চালাতে সমস্যা হওয়ায় পরে মৌলভীবাজার শাখা অন্য একটি ভবনে সরিয়ে নেয়া হয়।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, ২০০৩ সালে স্ত্রী গুলশান আরা বেগমের নামে জমিটি দখলে নেয়ার চেষ্টা শুরু করেন হাজী সেলিম। সে সময় এর একটি দলিলও বানান তারা। আর জায়গা না ছাড়ায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের হুমকিও দেয়া হয়।
এরপর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা করে। সেই মামলা এখনও চলছে।
- আরও পড়ুন: কী আছে সেলিমপুত্রের ‘টর্চার সেলে’
চলতি বছরের মার্চে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর ব্যাংকের কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে। এই সুযোগে হাজী সেলিমের লোকজন জায়গাটি দখল করে। তারা বুলডোজার দিয়ে পুরনো ভবন গুড়িয়ে দিয়ে সীমানা প্রাচীর তুলে দেয়।
এই ঘটনায় গত ২০ মে চকবজার থানায় লিখিত অভিযোগ করেন ওই শাখার দায়িত্বে থাকা সহকারী মহাব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মণ্ডল। ১৫ জুন র্যাব-৩ এর কাছেও অভিযোগ দেন তিনি।
হাজী সেলিমের স্ত্রীর নামে জমি দখলের পর র্যাবের কাছে জমা দেয়া অভিযোগ
যদিও চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মওদুত হাওলাদার দাবি করেছেন, তার থানায় কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা দেওয়ানি মামল। আদালতে এই মামলাটি চলছে। আমাদের এখানে কোনো মামলা নেই।’
বৈষ্ণব দাস মণ্ডল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৪৭ সাল থেকে ওই এলাকার সবাই জানে এটা হাবীব ব্যাংকের জায়গা। পরে অনেকগুলো ভবন হওয়ার কারণে আমাদের এই শাখা পেছনে পড়ে যায়। ফলে আমরা ব্যাংকটি সামনে নিয়ে আসি।
‘এখানে আমাদের আশপাশের যত শাখা আছে সব শাখার গোডাউন ছিল। এখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল রাখা হতো’-বলেন বৈষ্ণব।
- আরও পড়ুন: হাজী সেলিমপুত্র দেহরক্ষীসহ কারাগারে
এ বিষয়ে হাজী সেলিমের বক্তব্যের জন্য বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত সহকারী মো. সোহেলকে বারবার ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
রোববার রাতে ইরফান সেলিমের গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগায় অন্য একটি গাড়িতে থাকা নৌ-বাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় ইরফানকে গ্রেফতারের জন্য সোমবার দিনভর অভিযান চালায় র্যাব। রাতে তাকে গ্রেফতারও করা হয়।
সোমবার হাজী সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার ছেলে ইরফান সেলিমকে গ্রেফতার করে র্যাব
এই অভিযানের সময় হাজী সেলিম ও তার স্ত্রীকে বাসায় পাওয়া যায়নি। র্যাব জানিয়েছে, সকালে হাজী সেলিম ডাক্তার দেখানোর কথা বলে ঘর থেকে বের হন। আর ফেরেননি।
- আরও পড়ুন: ডাক্তার দেখাতে গিয়ে লাপাত্তা হাজী সেলিম