বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ‘ডি’ ব্লকের ১২ তলায় মনোবিজ্ঞান বিভাগের করিডোরে দেখা এক কিশোরের সঙ্গে। সে ঢাকার একটি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে।
অনলাইনে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছে। সে জানায়, দেখা শুরু দশম শ্রেণিতে থাকার সময়। বাসায় একা থাকতে বা গভীর রাতে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাইটগুলো ব্রাউজ করত। এ থেকে তৈরি হয় আসক্তি।
পড়ালেখায় ক্ষতি হচ্ছে দেখে এখন বের হতে চায় আসক্তি থেকে। কিন্তু পারছে না। তাই এই হাসপাতালে এসেছে চিকিৎসা নিতে।
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ অনলাইন আসক্তি দূর করতে কাউন্সেলিং করে থাকে। এখানকার মনোবিদরা বলছেন, বেশিরভাগই আসে পর্ন সাইট থেকে দূরে থাকার বাসনা নিয়ে। আর এদের একটি বড় অংশই কিশোর। করোনা মহামারিতে এই সংখ্যাটা আরও বেড়েছে।
যারা আসে, তাদের মধ্যে সংখ্যায় কম হলেও কিশোরী বা তরুণীও আছে ।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী জানান, তিনি আসক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর।
মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব নিউজবাংলাকে বলেন, মহামারিকালে তারা মানসিক রোগী পাচ্ছেন আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে পর্নোগ্রফিতে আসক্ত রোগীও আছে।
বাংলাদেশে পর্ন সাইটগুলো ব্লক করে রেখেছে বিটিআরসি। তারপরও আসক্তি বাড়ার কারণ হলো ভিপিএন দিয়ে বিকল্প পথে সাইটে ঢোকার কৌশল অজানা নয় কিশোর-কিশোরীদের কাছে।
ঢাকায় স্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফি দেখে বলে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ২০১১ সালের গবেষণায় তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য পুরনো হলেও বর্তমান সময়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
পর্ন আসক্তির সঙ্গে ধর্ষণের সম্পর্ক কী, সেটা নিয়ে গবেষণা হয়নি কোনো পর্যায়ে। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু ধর্ষণ মামলায় কিশোরদের আসামি হতে দেখা গেছে। একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কিশোররা অনলাইনে ভিডিও আপলোড করেছে।
ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কারণে কাজ ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। ফলে অনেকে বেশি সময় ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে শিশুরা। স্মার্টফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে শিশুরা এই অন্ধকার জগতের দিকে পা বাড়াচ্ছে।’
পর্নোগ্রাফির কারণে ধর্ষণ বাড়ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দাবি করতে পারব না, তবে পর্নোগ্রাফির কারণে যৌন চাহিদা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। যে কারণে ধর্ষণের দিকে ঝুঁকতে পারে। তবে এটাও ঠিক, যেসব দেশে পর্নোগ্রাফি দেখা হচ্ছে না সেই সব দেশেও ধর্ষণ হচ্ছে। আবার এমন অনেক দেশ আছে যেখানে পর্নোগ্রাফি প্রকাশ্যেই দেখা হয়, কিন্তু সেসব দেশে ধর্ষণ অনেক কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, অনলাইনে ক্লাস হয় বলে শিক্ষার্থীরা এখন ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকলেও বাবা-মা কিছু বলেন না। এটাই হয়তো আসক্তি বাড়ার কারণ হতে পারে।
গবেষক যা বলছেন
কিশোরদের মধ্যে পর্নোগ্রাফি দেখার প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক শাহানা হুদা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত।’
প্রায় এক দশক ধরে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইসের সহজলভ্যতা এই আসক্তি বাড়িয়েছে বলেই বিশ্বাস শাহানার। তার ধারণা, মাদকও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে ইয়াবা ও পর্নোগ্রাফি যদি কোনো কিশোরের মাথার মধ্যে কাজ করে তবে সেটা একটি বিকৃত রূপ ধারণ করে।’
গবেষণাটি সে সময় করেছিলেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষক আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন সিডি, ডিভিডি দেখে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়তো শিক্ষার্থীরা। এখন তো প্রেক্ষাপট ভিন্ন। অনলাইনে আসক্তি বেড়েছে।’
টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষ বিটিআরসি বলছে, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয় কোটির বেশি। এদের মধ্যে আট কোটি ৪৭ লাখ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। বাকিদের ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার ব্রডব্যান্ড আর ৮৩ হাজার ওয়াইম্যাক্স ব্যবহারকারী। আর পর্নোগ্রাফি বেশি দেখা হয় মোবাইল ফোনে।
২০১৯ সালে বিটিআরসি ২৪৪টি পর্ন সাইট ব্লক করে দেয়। এর আগে ২০১৭ সালে ৪০০টি সাইট বন্ধ করা হয়েছিল।
তবে গবেষক মামুন মনে করেন, সাইটগুলো শুধু টাইটেলের ভিত্তিতে বন্ধ করা হচ্ছে, কন্টেন্টের ভিত্তিতে নয়। ফলে সহজেই সাইটগুলোতে ঢুঁ মারা যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বয়স নিয়ে তেমনভাবে কোনো জরিপ করিনি। তবে ১৮-৩৫ বছর যাদের বয়স এবং তাদের মধ্যে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের শতভগই একবার হলেও পর্নোগ্রাফি দেখেছেন৷ নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখেন ৯০ ভাগ৷ তিনি উল্লেখ করেন, এখন মেয়েদের পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে পর্নোগ্রাফির প্রবণতা বাড়ছে৷ টেক্সট, ছবি ও ভিডিওর বাইরে অডিও পর্নোগ্রাফি একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে৷ পেশাদারদের মাধ্যমে সেক্স টেক্সটের অডিও তৈরি করে তা অনলাইনে ছাড়া হচ্ছে৷ ইউটিউব-এ ‘আপ’ করা হচ্ছে৷ এর বাজারও বাড়ছে৷ আসলে আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, এর বড় একটি অংশ মোবাইলে অডিও পর্নোগ্রাফি শোনে৷’
বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে পর্ন
বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি তৈরি ও তা বিক্রির উদাহরণ আছে৷
নয় বছর ধরে পথশিশুদের দিয়ে পর্ন তৈরি করে ইন্টারনেটে পে-ওয়েবসাইটে বিক্রির অভিযোগ আছে শিশুসাহিত্যিক টি আই এম ফখরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়ার বিরুদ্ধে।
২০১৪ সালে তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে আটক হন। টিপু আদালতে জানান, তিনি পর্ন ছবি তৈরি করে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের তিন ব্যক্তির কাছে পাঠাতেন। এদের একেকজনের কাছ থেকে প্রতি মাসে তিনি ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পেতেন।
সিআইডি জানায়, বিদেশিদের চাহিদা মোতাবেক টিপু কিবরিয়া কয়েক হাজার ছবি বানিয়েছেন।
গত ১৯ অক্টোবরও চাইল্ড পর্নোগ্রাফি তৈরির অভিযোগে তিন জনকে গ্রেফতার করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
গবেষক আবদুল্লাহ আল মামুন মনে করেন, বাংলাদেশে চারভাবে পর্নোগ্রাফি তৈরি হয়। প্রথমটি হলো নারী-পুরুষের সম্পর্কের ভিডিও বা অডিও। এটি একজনের অজান্তে অন্যজন ধারণ করে৷
আবার উভয়ের সম্মতিতে ভিডিও, অডিও বা স্টিল ছবি তোলা হয় গোপন রাখার শর্তে৷ পরে যেকোনো একজন তা প্রকাশ করে দেন৷
নারী-পুরুষের অজান্তে তাদের ডেটিং প্লেস ঠিক করে দেয়া ব্যক্তিও গোপনে ভিডিও ধারণ করে। এখন বাণিজ্যিকভাবে পেশাদারদের মাধ্যমেও তৈরি হচ্ছে নীল ছবি।
লকডাউনে আসক্তি বেড়েছে সব দেশেই
বিশ্বের সবচেয়ে বড় পর্ন ওয়েবসাইট ‘পর্নহাব’ সম্প্রতি জানিয়েছে, লকডাউনে পর্ন দেখায় রেকর্ড করেছে ভারত।
রিপোর্ট বলছে, যে দেশে যত দ্রুত লকডাউন চালু হয়েছে, সেখানে তত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে পর্ন ট্রাফিক।
১১ মার্চ পর্ন সাইটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ট্রাফিক ছিল ইতালিতে।
লকডাউনের মধ্যে ফ্রান্সে পর্ন দেখার প্রবণতা বেড়েছে ৪০ শতাংশ, জার্মানিতে ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ২৬ শতাংশ, ইতালিতে ৫৫ শতাংশ, রাশিয়াতে ৫৫ শতাংশ ও স্পেনে ৬০ শতাংশ আসক্তি বেড়েছে।