আবেদনের যোগ্যতাই নেই, তবু মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ দিতে হবে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের নীতিমালাই বদলে দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান।
শুধু এই নিয়োগ নয়, নিয়মের পরোয়া না করে অথবা বিধিমালা শিথিল করে অন্তত ৩৪ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো বেশকিছু পদেও হয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি। এসব দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে আব্দুস সোবহানের সময়ের স্বেচ্ছাচারী সব নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এবং বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ইউজিসি।
তদন্ত প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা। এতে বলা হয়েছে, উপাচার্য ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ওঠা ২৫টি অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগেরই প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল সবার সম্পদের উৎস গোয়েন্দাদের মাধ্যমে অনুসন্ধানের সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
উপাচার্য আব্দুস সোবহান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ খুলে সেখানে মেয়েকে ও ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) জামাতাকে নিয়োগের জন্য নীতিমালা পুরোপুরি বদলে দেন।
আগের নীতিমালায় শিক্ষক পদে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল সনাতন পদ্ধতিতে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত চারটি স্তরেই প্রথম শ্রেণি অথবা গ্রেড পদ্ধতিতে এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৪.৫০, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে ন্যূনতম সিজিপিএ-৩.৫০।
এ ছাড়া আবেদনকারীকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মেধাক্রমে প্রথম থেকে সপ্তমের মধ্যে থাকতে হবে। তবে এই নীতিমালা পরিবর্তন করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ মোটা দাগে ৩.২৫-এ নামিয়ে আনা হয় এবং মেধাক্রমে থাকার শর্তও তুলে দেয়া হয়।
এর পর উপাচার্যের মেয়ে সানজানা সোবহান এবং জামাতা এ টি এম শাহেদ পারভেজ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। অথচ বিভাগে উপাচার্যকন্যার মেধাক্রম ছিল ২১তম, আর জামাতার এমবিএ পরীক্ষায় মেধাক্রম ছিল ৬৭তম এবং তার ফল ছিল সিজিপিএ ৩.৪৭।
নতুন প্রতিষ্ঠিত ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সাধারণত প্রথমে টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয় থেকে পাস করা প্রার্থী নেওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে মার্কেটিং ও ব্যবস্থাপনার শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষক পদে আবেদনের সুযোগ রেখে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর মাধ্যমেই নিয়োগ পান উপাচার্যের মেয়ে। এছাড়া আবেদনের যোগ্যতা না থাকা ৩৪ জনকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
আইন অনুষদে প্রথম হওয়া, প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পাওয়া, এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রথম বিভাগ বা শ্রেণি থাকা আবেদনকারীকে বাদ দিয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন দুজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে একজন পরে উপউপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার মেয়েকে বিয়ে করেন।
তদন্ত কমিটি বলেছে, নীতিমালা পরিবর্তনের মাধ্যমে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে চলা চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা এখন সর্বনিম্ন।
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে সব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছে।
কমিটির প্রতিবেদনে যুক্ত করা তিন পৃষ্ঠার সুপারিশে উপাচার্য, উপউপাচার্য, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ছাড়াও অধ্যাপক মজিবুর রহমান, আব্দুল হান্নান, সহযোগী অধ্যাপক গাজী তৌহিদুর রহমান, শিবলী ইসলাম ও সাখাওয়াত হোসেন টুটলের সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।
একইসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার তদন্ত কমিটিকে অসহযোগিতা করায় তাকে অপসারণসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে ইউজিসি।
অনিয়মের জন্য উপাচার্যকে দায়ী করে ইউজিসি বলেছে, ‘এ ধরনের কর্মকাণ্ড উপাচার্যের মতো সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। তাই কমিটি মনে করে যে, নৈতিকতা বিবর্জিত এ ধরনের কর্মকাণ্ড জরুরিভিত্তিতে বন্ধ করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাসহ সার্বিক পরিবেশের উন্নয়নে সচেষ্ট হবে।’
ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষকদের একটি অংশ।
প্রগতিশীল শিক্ষক জোটের একাংশের নেতা ও ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতানুল ইসলাম টিপু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের একটিই চাওয়া, অনিয়ম দুর্নীতিগুলো বন্ধ হোক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩-এর সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী চলুক। অনিয়ম যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
‘এখানে কোন প্রশাসক আসবে সে সিদ্ধান্ত সরকার নেবে। কিন্তু আমরা শিক্ষক হিসেবে চাইব এখানে শিক্ষার, গবেষণার এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশটা বজায় থাকুক। অন্যায়ের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করুক, যথাযথ আইন প্রয়োগ করা হোক।’
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোলাইমান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন করেছিলাম। এই অনিয়মগুলো ইউজিসিতে প্রমাণিত হয়েছে। এটা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটা মাইলফলক হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ইউজিসির প্রতিবেদনের বিষয়ে কিছু জানি না। আমাকে কেউ জানায়ওনি। তবে, আমি আগেই ইউজিসির এ কমিটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছি। চিঠি দিয়ে বলেছি, যথাযথ প্রক্রিয়ায় এই কমিটি করা হয়নি।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহী ব্যুরো প্রধান আহসান হাবীব অপু।