রাজধানীর পলাশীর ছাপড়া মসজিদ এলাকা। জটলা বেঁধে অপেক্ষায় দেড় থেকে দুইশ মানুষ। কেউ লাইনে, কেউ গোল করে বসে ফুটপাতে।
এই অপেক্ষা ২৫ টাকায় আলু কিনতে। টিসিবি বাজার দরের প্রায় অর্ধেকে আলু দেবে, এই খবর পেয়েছেন মানুষগুলো। এই এলাকায় অপেক্ষার কারণ, টিসিবি এখানে ট্রাকে করে নিত্যপণ্য বেচে।
তবে কখন আসবে ট্রাক, সেটা জানা ছিল না। তাই সকাল আটটা থেকেই অপেক্ষা। বেলা দেড়টার পর আসে বহুল প্রতিক্ষিত সেই ট্রাক। তখন আলু কেনার লাইন আকার নেয় বিরাট। শুরু হয় ঝগড়া।
লালবাগ থেকে আসা মনি বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আলু নিয়া তারা তামাশা করতাছে। সংবাদে দেহি একবার কয় ৩৫ টেহা, আবার কয় ৩০ টেহা। দোকান থিকা কাল্লাও কিনছি ৪৫ টেহা দিয়া৷ এইহানে ২৫ টাকায় বেচব হুইনা আইলাম। আটটা থিকা বইয়া আছি৷ আজান দিয়া দিছে৷ কোনো খবর নাই। গতকাইলও দুপুর পর্যন্ত আইয়া বইয়া ছিলাম। ট্রাক আহে নাই।’
রাজধানীর পলাশী এলাকায় টিসিবির আলু কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চুড়ি বিক্রি করেন মাজেদা বেগম। তিনিও এসেছেন পেঁয়াজ আর আলু কিনতে। বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আলু আমগোর আসল খাওন। কিচ্ছু না থাকলে আলু টিপ্পা খাইয়া লই। পোলাডাও আলু হইলে আর কিচ্ছু চায় না। এনে (এখানে) ২৫ টাকায় বেচব হুইনা আইলাম দোকান বন্ধ কইরা। খবর নাই কোনো।’
করোনাকাল নিম্ন মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের ব্যবধান যে অনেকটাই ঘুঁচিয়ে দিয়েছে, তা এই লাইনেই বোঝা গেছে।
বেসরকারি আইটি কোম্পানিতে চাকরি করেন এমন একজন বললেন, ‘করোনার শুরু থেকে স্যালারি বন্ধ। আগে কখনও ট্রাক থেকে জিনিস কিনতে আসিনি। কিন্তু এই সময়ে, ১০ টাকা বাঁচানোও অনেক কিছু। তাই আসা।’
‘সকাল থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছি। অফিস থেকে প্রেসার আছে। বারবার ফোন দিচ্ছে। বলেছি, স্ত্রী অসুস্থ।’
মঙ্গলবার রাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ট্রাকে করে আলু বিক্রির যে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়, সেখানে কখন, কোথায় আলু বিক্রি হবে, সেটা জানানো হয়নি।
আলু কিনতে আসা মোজাম্মেল মিয়া বলেন, ‘এলাকা ও নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিলে সবারই উপকার হতো। সময় বাঁচত।’
ডিলারদের একজন আবির আহমেদ। বলেন, ‘শাহবাগে আন্দোলন হইতেছে। জ্যামে পড়ছিলাম। তাই দেরি হয়েছে। আর আমাদের ভেন্যু খালি পরিবর্তন হয়। তাই লোকজন ফোন দিলেও আমরা কোনো সময় দিতে পারি না। সবাই যেভাবে রিকুয়েস্টের সুরে কয়, আহাজারি করে কী বলব বুঝি না। খালি বলি এইতো আধা ঘণ্টা আসতেছি।’
এই চিত্র সব জায়গায়। বাজার নিয়ন্ত্রণে ট্রাকে করে টিসিবে যে আলু বিক্রি করছে, সেটি চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ন কবির জানিয়েছেন, ঢাকায় সর্বমোট ৮০ টি ট্রাকে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ট্রাকের জন্য বরাদ্দ ৩০০ কেজি।
তারা একজনের কাছে সর্বোচ্চ দুই কেজি আলু বিক্রি করতে পারবেন। অর্থাৎ ১২ হাজার মানুষ কিনতে পেরেছেন ২৪ হাজার কেজি।
ফলে এটা সহজেই বোঝা যায় যে, ট্রাকের সামনে ভিড় ব্যাপক।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবশ্য সকাল ১০ টার দিকেই চলে আসে ট্রাক। ক্রেতার তুলনায় ট্রাকে পর্যাপ্ত আলু নেই। শেষ হয়ে যায় দুপুরের আগেই।
আলু কিনতে না পেরে ফিরে যাওয়া রহমান মিয়া বলেন, ‘দোকান থিকা ৪৫/৫০ টাকায় আলু কিনতে গিয়া এক লস, এখানে আইসা আলু না পাইয়া আরেক লস। ভোগান্তি সব আমাদেরই।’
খামারবাড়ি এলাকায় আলুর জন্য যে ভিড়, তাতে বেশিরভাগ ছিলেন রিকশাচালক।
এদের একজন রুহুল ফকির লাইনের অনেক পেছনে। শেষ পর্যন্ত আলু পাবেন কি না, সন্দিহান। তারপরেও দীর্ঘ সময় লাইনে অপেক্ষা করেন। যদিও এই সময়ে তিনি ভাড়া পেতে পারতেন এক বা একাধিক।
কেন এত অপেক্ষা করে লাইনে? রুহুল বলেন, ‘পেঁয়াজ-তেল তো কয়েক সপ্তা পর পর কিনলেও অয়। আবার পেঁয়াজ তরকারিত না দিলেও অয়। কিন্তু আলু তো প্রত্যেক দিন লাগে। এর লাইগ্যাই দাঁড়াইলাম।’
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ন কবির এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সকাল থেকেই আমাদের গুদাম থেকে পণ্য সংগ্রহ করে ডিলাররা। এখন একটা ট্রাক যদি সিরিয়াল অনুযায়ী ৩০ নাম্বারে এসে দাঁড়ায়, স্বাভাবিকভাবেই তার পণ্য লোড করে নির্ধারিত জায়গায় যেতে সময় বেশি লাগবে।’
‘তাছাড়া যানজটের ব্যাপারটাও ভাবতে হবে।’