চলতি বছর ঢাকায় দুটি উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ৫.২৮ ও ১০.৪৩ শতাংশ। এত কম ভোট এর আগে পড়েনি কোনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে।
দিনভর ভোটারের দেখা নেই। অলস সময়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছেন নিরাপত্তাকর্মী। এ ধরনের একটি ছবি ছড়িয়েছে ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে।
শনিবার আসনটিতে ভোট পড়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। তবে ভোটারের খরা এর চেয়েও বেশি দেখেছে ঢাকা।
গত ১৮ এপ্রিল ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়ে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।
ঢাকার বাইরের চিত্র অবশ্য এমন নয়। যেদিন ঢাকা-৫ আসনে ভোট হয়েছে, একই দিন ভোট হয়েছে নওগাঁ-৬ আসনেও। সেখানে ভোট পড়ে রাজধানীর সাড়ে তিন গুণের মতো; ৩৬ দশমিক ৪৯।
দুটি আসনেই ভোট নেয়া হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ইভিএমে। ভোটারের আঙুলের ছাপ মিললেই কেবল ভোট দেয়া যায় এই পদ্ধতিতে। ফলে সিল মারার মতো কোনো সুযোগ ছিল না। তাই প্রশ্ন ওঠে ঢাকায় এত কম ভোটার নিয়ে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা ভোটার কম আসার যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে ভোট হয়। এই খণ্ড নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কম থাকে। নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য সরকার পরিবর্তনের সুযোগ নেই। দুই-আড়াই বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন সেই জন্য হয়তো প্রার্থী বা ভোটারদের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই।’
অবশ্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকাতে দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়ে ২৫.৩ ও ৩০ শতাংশ। সেটা কোনো খণ্ড নির্বাচন ছিল না।
শনিবারের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ ভোট পেয়েছেন দুই হাজার ৯২৬। যদিও ভোটে কারচুপির অভিযোগে পরদিন তার বিক্ষোভে নেতাকর্মী এসেছিলেন এর চেয়ে বেশি।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি সমাবেশগুলোও ছোট হয়নি। কিন্তু তারাও ভোট পেয়েছে ৪৫ হাজার ৬৪২টি। অর্থাৎ কেন্দ্রপ্রতি ২৪৪টি। অথচ কেন্দ্রে কেন্দ্রে এর চেয়ে বেশি নেতাকর্মী উপস্থিত থেকেছে দিনভর।
এর আগে ঢাকা-১০ আসনে নৌকা মার্কায় জয়ী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ভোট পান ১৫ হাজার ৯৯৫টি। এত কম ভোটে সংসদ সদস্য বর্তমান সংসদে একজনও নেই।
প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকায় ভোটাররা কেন কেন্দ্রে যাচ্ছেন না, দলের নেতা-কর্মীরাই বা কোথায়।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বক্তব্য একই ধরনের। দুই পক্ষের নেতারাই বলছেন, কে জিতবেন, সেটা ভোটারদের জানা আছে। তাই তারা ভোট দিতে যাচ্ছে না।
বাইরে নেতাকর্মীদের এমন ভিড় থাকলেও তারা ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে আগ্রহী করতে পারেননি
কে কী বলছেন
রাজনীতি বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটা সময় দেখেছি নারীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছে। কিন্তু এখন কেন এমন হলো? এর মূল কারণ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা। ভোট দিয়ে এখন কারও কিছু যায় আসে না।
‘আবার ভোট দিতে চাইলেও যে ভোট দেয়া যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। ভোট দিতে গেলেও সেখানে বিভিন্ন রকম হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ মনে করেন কম ভোট পড়ার জন্য দুটি কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘করোনার মধ্যে তারা কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে চায় না। আর তারা আগে থেকেই জানে এখানে কার বিজয় নিশ্চিত। তাই সেখানে গেলেই কী বা ভোট না দিলেই কী?’
কিন্তু করোনার আগেও তো ভোটের হার খুব বেশি ছিল না, এমন প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলের নেতা আবার বলেন, `কে জিতবে, সেটা নিয়ে ভোটাররা নিশ্চিতই থাকে। তাই তারা ভাবে, কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই।‘
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মতে, ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ ‘একদম সিম্পল’।
তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে নির্বাচনে ভোটের আগের রাতে ডাকাতি করেছে। অতীতে দিনের বেলায় সিল দিয়ে নিয়েছে আর এখন রাতে ডাকাতি করে নিচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই জনগণ ভোটের প্রতি অনীহা বা আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা বড় ধরনের হুমকি।’
‘আপনাদের প্রার্থী ভোটের পরদিন যত নেতাকর্মী নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন, তত ভোটও পাননি। তাহলে নেতা-কর্মীরা কেন কেন্দ্রে যাননি’, এমন প্রশ্ন ছিল মোশাররফের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, ‘নেতাকর্মীদের তো নিরাপত্তা নেই। আগের রাতে সন্ত্রাস করে তাদেরকে ভোট কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয় না।’
‘কিন্তু যখন মাত্র ১০ ভাগ ভোট পড়ে সেখানে আওয়ামী লীগের ভোটার কোথায় থাকে? তারা তখন কী বলবে? এর অর্থ হচ্ছে মানুষ এখন ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে’, বলেন সাবেক মন্ত্রী।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘মানুষ এখন বুঝে গেছে যে সে ভোট দিল কী দিল না, তার ওপর ফলাফল নির্ভর করে না।’
সিপিবি নেতা বলেন, ‘যিনি ভোট দিতে যাবেন তার তো আগে এটা বুঝতে হবে যে তিনি নির্বিঘ্নে ভোট দিতে যেতে পারবেন। এরপর ভোটার যে ভোট দেবেন সেটা ঠিকমতো গণনা হয়েছে কি না, সেই বিষয়টিও তাকে নিশ্চিত হতে হবে। কিন্তু এসব বিষয়ের ব্যত্যয় ঘটেছে।’