আপনি এমন একটা ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থার কথা চিন্তা করুন, যেটি বুদ্ধিমান। একটা বেঁধে দেয়া সময় অন্তর সেটার সিগনাল বাতি জ্বলে-নেভে না। বরং রাস্তায় যানবাহনের পরিবর্তনশীল চাপ বিবেচনায় নিয়ে, অন্যান্য সড়কমোড়ের সিগনালের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বলে-নেভে এই ব্যবস্থার বাতি।
এরকম ব্যবস্থায় রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা না করে খুব সহজেই আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌছে যেতে পারবেন। আপনাকে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাফিকের লাল, সবুজ বা হলুদ বাতির উপর নির্ভর করে থাকতে হবে না।
এ সবকিছু সম্ভব হবে ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেমের (আইটিএস) কল্যাণে। বর্তমানে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশেই এ প্রযুক্তি চালু আছে। তবে রাজধানী ঢাকার সড়কমোড়ে যেখানে স্বয়ংক্রীয় সিগনাল-বাতি কার্যকর করাই সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে উন্নত বিশ্বের এই সর্বাধুনিক ব্যবস্থা কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নগরবিদেরা।
আইটিএস ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আরও পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালে। ঢাকার চারটি মোড়ে আংশিকভাবে এই ব্যবস্থা চালু হবে। পুরোপুরি চালু হতে আরো সময় লাগবে।
আইটিএস ব্যবস্থায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ও বিভিন্ন স্থানে বসানো সেন্সর সড়কে থাকা গাড়ির পরিমাণ শনাক্ত করবে। যন্ত্রটি মোড় থেকে তিনশ মিটার দূরে থাকা গাড়ির সংখ্যাও গুণতে পারবে। এরপর নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে কোন দিকে গাড়ি চলাচলের জন্য বা বন্ধ করার বাতি জ্বালানো হবে। রাস্তায় জরুরি কাজে কোনো গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকলে কিভাবে সেটিকে দ্রুত সম্ভব গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাও ঠিক করে দেবে এই ব্যবস্থা।
আইটিএস ব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শফিক-উর রহমানের সাথে। তিনি জানান, এই পদ্ধতি ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তবে তিনি এই পদ্ধতি কার্যকর হওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
কীভাবে এই ব্যবস্থা কাজ করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেন্সর নেটওয়ার্ক, ডেডিকেটেড ট্রাফিক কন্ট্রোল ও নিরাপত্তা পদক্ষেপ – মূলত এই তিনটির সমন্বয়ে কাজ করবে আইটিএস। এছাড়া আরো অনেক বিষয় এর সাথে জড়িত আছে।
ড. শফিক-উর রহমান জানান, এটি অনেকটা গ্লোবাল পজ়শনিং সিস্টেমের (জিপিএস) মতো কাজ করবে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গাড়ি শনাক্ত করা বা তার অবস্থায় নির্ণয় করাও যাবে আইটিএসের মাধ্যমে।
সেন্সর নেটওয়ার্কের কাজ হবে রাস্তার যানবাহন পরিমাপ করা। এটি রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় লাগানো থাকবে। এর ফলে মূলত রাস্তায় কখন যানবাহনের চাপ বেশি বা কম, তা বোঝা যাবে।
ডেডিকেটেড ট্রাফিক কন্ট্রোলের কাজ হবে হবে সেন্সরের কাছে থাকা যানবাহনের তথ্য সংগ্রহ করে রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করা। যানবানহের চাপ ও রাস্তার অবস্থার যে তথ্য সেন্সরে আসবে, তা সংগ্রহ করে সে অনুযায়ি রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করবে এটি।
তৃতীয় ব্যবস্থাটির কাজ হবে সড়কে যানবাহনের নিরাপত্তার ব্যাপারটি দেখা। এর মাধ্যমে রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা হলে তা নির্ণয় করা যাবে এবং কোন ধরনের গাড়ি সেখানে আগে যাবে (পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্স) সেটাও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
চালু হবে জুনে
২০১৫ সালের জুলাইতে কাজ শুরু হয়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সেটি এখন পিছিয়ে ২০২১ সালের জুনে চলে গেছে।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ে চারটি জায়গায় এই সংকেত চালু হবে। এগুলো হলো গুলশান ১ সড়কদ্বীপ, মহাখালী মোড়, পল্টন মোড় ও ফুলবাড়িয়া মোড়। এই চার জায়গায় এটি সফল হলে পরে অন্যান্য স্থানগুলোতেও বসানো হবে।
ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এই প্রকল্পের অর্থায়ন করে। প্রাথমিকভাবে ৩৬ কোটি টাকা ঠিক করা হয় প্রকল্পের ব্যয়। কিন্তু দুই ধাপে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে তা এখন ৫২ কোটি টাকাতে পৌছেছে।
ডিটিসিএ-এর প্রকল্প পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস শাহ নিউজবাংলাকে বলেন, সংকেতবাতি চালু হওয়ার পর তা মেনে চলতে পথচারী ও চালককে সচেতন করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ইলিয়াস শাহ বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এই পদ্ধতি চালু করতে দেরি হচ্ছে। সিগনাল বাতি স্থাপনের কাজ অনেক আগে শেষ হয়েছে। কিন্তু সফটওয়্যারে ত্রুটির কারণে তা চালু করা যায়নি।
ঢাকা দক্ষিন ট্রাফিকের যুগ্ম কমিশনার বাসুদেব বনিক নিউজবাংলাকে বলেন, আইটিএস চালু হলে সবক্ষেত্রে যে সুবিধা পাওয়া যাবে, তা নয়। ভিআইপি রাস্তাগুলোয় এটি চালু করা সমস্যা হবে না। তবে যেসব রাস্তা দিয়ে রিকশা চলাচল করে, সেগুলোয় এই ব্যবস্থা কার্যকর করা কঠিন হবে।
ড. শফিক-উর রহমান বলেন, বর্তমান রাজধানীর সড়কের যে বিশৃঙ্খল অবস্থা, তাতে এই প্রকল্প চালু দিয়ে সুফল পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, যেখানে স্বয়ংক্রিয় সিগনাল বাতিই চালু করা যায়নি, সেখানে আইটিএস কিভাবে চালু হবে? তাছাড়া ঢাকার সব রাস্তায় এই পদ্ধতি চলবে কি না সেটাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার।