মানবতাবিরোধী অপরাধে ময়মনসিংহের খলিলুর রহমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি শেষ প্রায় ৯ মাস আগে। কিন্তু রায় কবে, জানা নেই।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর কোনো মামলা শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষায় থাকেনি এত দিন।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম রায় আসতে সময় লাগে প্রায় তিন বছর। সাবেক জামায়াত নেতা আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির আদেশ আসে ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি। আর ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর আসে শেষ রায়।
প্রথম রায়ের পর প্রায় সাত বছরে মোট ৪১টি মামলার রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। তবে গত ১১ মাসে আসেনি একটিও। অথচ অন্তত দুটি মামলার রায় আসতে পারত বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।
এখনও ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৬টি। এই মামলাগুলোর একটিতেও গত ১১ মাসে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন হয়নি। দুই একটি মামলায় কেবল সাক্ষ্যগ্রহণ ও জামিন শুনানি হয়েছে।
এই সময়ে তদন্ত সংস্থার জমা দেয়া চারটি প্রতিবেদন প্রসিকিউশন টিম ট্রাইব্যুনালকে দিতেও পারছে না। ফলে সেগুলোতেও অভিযোগ গঠনের শুনানি আটকে গেছে।
ট্রাইব্যুনাল থমকে যাওয়ার কারণ আইনি জটিলতা। ট্রাইব্যুনাল বিধিমালা ২০১০ এর ২৬ (১) ধারা অনুযায়ী অপরাধ আমলে গ্রহণ ও রায় প্রদানের সময় ট্রাইব্যুনালের সব সদস্যের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।
তবে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য গত ২২ মার্চ আমীর হোসেন ভারতে যান। এখনও সেখানেই আছেন। ফলে চেয়ারম্যান শাহিনুর ইসলাম ও সদস্য আবু আহমেদ জমাদার শুনানি নিতে পারছেন না বা রায় দিতে পারছেন না।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিন বিচারকের ফুল বেঞ্চ না থাকলে কোন মামলা আমলে নেয়া, অভিযোগ গঠন, যুক্তিতর্ক গ্রহণ ও রায় দেয়ায় বাধা আছে।’
এই অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে থাকা মামলা নিষ্পত্তিতে জটিলতার আশঙ্কা করছেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ দ্রুত শেষ হওয়ার দরকার। কেননা আমাদের সাক্ষীদের মধ্যে অধিকাংশের বয়স ৭০ এর ঊর্ধ্বে। এ অবস্থায় বয়স্ক এসব সাক্ষীদের ধরে রাখাও মুশকিল।’
এই অবস্থায় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালটি আবার চালুর পরামর্শ দিয়েছেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক।
২০১২ সালের ২২ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। তবে শীর্ষ সন্দেহভাজনদের মামলায় রায়ের পর পর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এটি নিষ্ক্রিয় করা হয়।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাপারটা আমি দেখব।’
তবে যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারলেও এক বিচারকের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্যগ্রহণের সুযোগ আছে। আর এ বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায় সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
‘সাক্ষী হাজির, জামিন সংক্রান্ত আবেদনের বিষয়টি ভার্চুয়ালি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। … নিরাপত্তা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বিচারক প্যানেলের সুরক্ষিত স্বচ্ছ গ্লাস দিয়ে দেয়াল দেয়া হয়েছে। সাক্ষী ও আসামিদের জন্য নির্ধারিত জায়গাগুলো স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়েছে।’
করোনার শুরুতেই ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকায় ২৯ জন পুলিশ সদস্য, তিন জন প্রসিকিউটর করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারা সবাই অবশ্য সুস্থ হয়েছেন। যদিও স্ত্রী হারিয়েছেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন।
ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার পর ২০১৩ সালে আটটি মামলার রায় এসেছে।
২০১৪ সালে ছয়টি, ২০১৫ সালে সাতটি, ২০১৬ সালে ছয়টি, ২০১৭ সালে দুইটি এবং ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ছয়টি করে মামলার রায় হয়েছে।
যে ৪১টি মামলার রায় হয়েছে তাতে আসামি ছিলেন ৯৫ জন। যার মধ্যে ৭০ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা এসেছে ট্রাইব্যুনাল থেকে।
এর মধ্যে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। সাজা বাড়ে আপিল বিভাগে। আর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পর আপিল বিভাগ জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে।
আরেক জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায় আপিল বিভাগ বহাল রেখেছে। এখন রিভিউ ও রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আনুষ্ঠানিকতা বাকি।
তদন্ত সংস্থা এখনো ২৮টি মামলার তদন্ত চালাচ্ছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৪০ জন।