ঢাকার সাভার থেকে সোহরাওয়ার্দী কলেজ পর্যন্ত লাব্বায়েক ও ওয়েলকাম পরিবহনে ভাড়া ২৫ টাকা। তবে বেশিরভাগ যাত্রী নামেন আসাদ গেটে। মাত্র এক দশমিক তিন কিলোমিটার বেশি চড়লেই দিতে হচ্ছে ৪০ টাকা।
কৌশল হলো বাসগুলো বাড়তি ১৫ টাকা নেয় পরীবাগ পর্যন্ত। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী কলেজের পরে যেখানেই নামবেন, সেখান পর্যন্তই দিতে হবে এই বাড়তি টাকা।
আবার কোনো যাত্রী শাহবাগ নামলে দিতে হয় ৫০ টাকা। কিন্তু তিনি যদি পরীবাগ নামেন, তাহলে দিতে হচ্ছে ৪০ টাকা।
পরীবাগে যাত্রী নামেন কমই; বেশিরভাগই নামেন শাহবাগ। এখানে ৫০০ মিটারের জন্য বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে ১০ টাকা। আসলে এই বাড়তি ১০ টাকা দিয়ে যাওয়া যায় মতিঝিল পর্যন্ত।
সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়ে গত তিন বছর ধরে রাজধানীর বাসগুলো চালানো হচ্ছে ‘ওয়েবিলে’।
এখানে দূরত্বের হিসাবে ভাড়া ঠিক না করে নির্দিষ্ট একটি এলাকা থেকে আরেকটি এলাকা পর্যন্ত ভাড়া ঠিক করা হয়। কেউ বাস কোম্পানির ঠিক করা দূরত্বের মাঝখানে নামলেও পুরো পথের ভাড়াই দিতে হয়।
এই ওয়েবিলগুলো কৌশল করে এমন জায়গায় বসানো হয়েছে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ নামে না। যেমন: শাহবাগের বদলে পরীবাগ, বাংলামোটরের বদলে সোনারগাঁও হোটেল, মগবাজারের বদলে সাতরাস্তায়।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যাত্রীরা ২৫০ বা ৩০০ মিটার দূরত্ব হেঁটে যেতে চায় না। সোনারগাঁও হোটেলে না নেমে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া মিটিয়ে যাত্রীরা নামেন বাংলামোটরে। সাতরাস্তায় না নেমে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া মিটিয়ে যাত্রীরা নামেন মগবাজারে।
অথচ প্রতিটি বাসই চলে লোকালের মতো। প্রতিটি মোড়েই যাত্রী তোলা হয়।
নগর পরিবহনে কোনো একটি স্থান থেকে অন্য একটি স্থানের ভাড়া কত হবে, আইন অনুযায়ী সেটা ঠিক হওয়ার কথা কিলোমিটার হিসেবে। এর মধ্যে বাসগুলোর এভাবে ভাড়া নির্ধারণে সরকারের কোনো অনুমোদন নেই। কিন্তু কখনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমন নজিরও নেই।
ওয়েবিল আর ওয়েবিল ছাড়া চলা বাসে সেবা বা মানে দৃশ্যত পার্থক্য নেই। সাভার থেকে ঢাকা রুটে চলা ঠিকানা ও মৌমিতায় চড়লে কলেজ গেটে দিতে হয় ২৫ টাকা। আর আসাদগেট বা ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের জন্য ৩০ টাকা।
একই চিত্র সবগুলো রুটে। ওয়েবিলের নামে নিত্যদিন ঠকানো হচ্ছে যাত্রীদের।
এর আগে নানা সময় ঢাকায় বাড়তি ভাড়া নেয়া হয়েছে ‘সিটিং’, ‘আল্লাহর কসম সিটিং’, ‘গেটলক’, ‘কম স্টপেজ’ প্রভৃতি নানা নামে। ভাড়া বাড়িয়ে বাসগুলো পরে আবার আসনের অতিরিক্ত যাত্রী তুলেছে।
‘ওয়েবিলের’ ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই কাহিনি। শুরুতে ওয়েবিলে আসনের বেশি যাত্রী তোলা না হলেও পরে থাকেনি যাত্রীদের সেই স্বাচ্ছন্দ্য। বাড়তি ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি করে চলতে হয়েছে তাদের।
করোনাকালে বাসে যাত্রী সংখ্যা এখন কিছুটা কম। ফলে আগের মতো বাসে অতিরিক্ত থাকে না সবসময়। তবে অফিস সময় আর ছুটির সময় এই চিত্র থেকেই যাচ্ছে।
যাত্রী ঠকানো যেভাবে
২০১৭ সালের শেষ দিকে নগর পরিবহনগুলোতে ভাড়া আদায়ে চালু হয় ‘ওয়েবিল’।
ওয়েবিল মূলত সিটিং সার্ভিস নামে চলা বাসগুলো একটি নির্ধারিত দূরত্বের পরপর কতজন যাত্রী উঠেছে, সেটি গণনা করার উপায়।
একজন লাইনম্যান নির্ধারিত দূরত্বে ওয়েবিলে যাত্রীর সংখ্যা লিখে দেন। পরে এটিই হয়ে যায় যাত্রী ঠকানোর নতুন কৌশল।
গাবতলী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর বা মহাখালী হয়ে আসা বাসগুলোর বেশিরভাগ যাত্রীই ফার্মগেটে নামলেও এই মোড়ে ওয়েবিল নেই। শাহবাগ বা কারওয়ানবাজার পর্যন্ত ভাড়া আদায় করতে ওয়েবিল বসানো হয়েছে আরও সামনে।
রাজধানীর ফার্মগেট থেকে সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত ওয়েবিলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ টাকা। এর মধ্যে যেকোনো স্থানে উঠানামার জন্য এই টাকা দিতে হয় যাত্রীদের। আর কেউ শাহবাগ গেলে ভাড়া ২৫ টাকা। অথচ ২৫ টাকা ভাড়া ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত।
রামপুরা থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলাচলকারী ‘স্বাধীন’, ‘রমজান’, ‘রাজধানী’ পরিবহনে স্টাফ কোয়ার্টার থেকে রামপুরা পর্যন্ত ভাড়া নেয় ২০ টাকা। আর ভেঙে ভেঙে যেখানেই যে নামুক, ওয়েবিলের কথা বলে ১০ টাকার নিচে ভাড়া নিতে চায় না।
গাবতলী-শাহবাগ রুটের নিয়মিত যাত্রী শাকিল আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওয়েলকাম তাকে টেকনিক্যাল থেকে বাসে উঠে শাহবাগ যেতে ভাড়া দিতে হয় ৩৫ টাকা। কিন্তু ভাড়া সর্বোচ্চ ২৫ টাকা হওয়ার কথা। হেলপারকে জিজ্ঞাসা করলে জানান, কোম্পানি ওয়েবিলে ভাড়া ঠিক করে দিয়েছে।’
বাস ভাড়া কোনো কোম্পানি ঠিক করবে নাকি বিআরটিএ, সে প্রশ্ন এই যাত্রীর।
আরেক যাত্রী রাকিব হায়দার বলেন, ‘এই ওয়েবিলটা আসলে কী? আমার তো মনে হয় ভাড়া বেশি নেয়ার কৌশল এটা।
‘ওয়েবিল করার পর সার্ভিস আরও খারাপ হয়েছে। তারা সিটিং সার্ভিস বলে সেবা দেবে। কিন্তু সব লোকাল হয়ে গেছে।’
বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর থেকে মৌচাক-মালিবাগ হয়ে ডেমরা রুটে চলাচলকারী লাব্বাইক পরিবহনের একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘বিআরটিএ আমাদের ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা একটা স্ল্যাব করেছি। আমরা সে হিসেবে ভাড়া নেই।’
তবে এই কর্মীর দাবি সত্য নয়। বিআরটিএ বলছে, মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া সাত টাকা। কিন্তু লাব্বাইকে ১০ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নেয়া হয় না। ওয়েবিলের কৌশলে আবার পাঁচ কিলোমিটার পথে কখনো কখনো হয়ে যায় ১৫ টাকা।
বিআরটিএ কী বলছে
বিআরটিএর পরিচালক (রোডস অ্যান্ড সেফটি) শেখ মাহবুব ই রব্বানী নিউজবাংলাকে বলেন, ওয়েবিলের বিষয়টি তাদের কাছে এতটা পরিচিত নয়। এই বিষয় দেখবে পুলিশ।
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। যখন মোবাইল কোর্ট চালাই, তখন অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নিই। এই ধরনের অভিযোগ যাত্রীরা তেমন একটা করে না।’
এক প্রশ্নে বিআরটিএ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা শুধু নির্ধারণ করে দিই। এরপর রাস্তায় যেকোনো নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তা দেখার দায়িত্ব পুলিশের। তবে কেউ যদি গাড়ির নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করে, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।’
যাত্রীকল্যাণ সমিতি যা বলছে
যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওয়েবিলের কাজ ভাড়া নির্ধারণ করা না। এর মাধ্যমে যাত্রীর সংখ্যা ও যাতায়াতের সময় রেকর্ড করা যেতে পারে। কিন্তু রাজধানীর সব পরিবহনগুলো এখন এই ওয়েবিলের নামে অতিরিক্ত ভাড়া ঠিক করেছে।’