পাওনা টাকা ফেরত চাওয়ায় চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আজিজুল ইসলাম মেহেদীকে তার বাল্যবন্ধু আহসান পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গত সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর হাতিরিঝিলের মেরুল-বাড্ডা এলাকা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার হয়েছিল অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে। পরে জানা যায়, তিনি চট্টগ্রামের আমেরিকা প্রবাসী ফখরুল ইসলামের একমাত্র ছেলে মেহেদী।
চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামি ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের মেহেদীর জন্ম সন্দীপের বাউরিয়া গ্রামে। মাকে নিয়ে চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ এলাকায় থাকতেন মেহেদী। লেখাপড়া শেষ করে কানাডা যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিচিতদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিং সহায়তা করতেন মেহেদী।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ হত্যায় জড়িত অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে চারজনকে গ্রেফতার করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। তাদের মধ্যে খিলক্ষেত উত্তরপাড়া থেকে মেহেদীর বাল্যবন্ধু আহসান ও সহকর্মী তামিম এবং হাতিরঝিল মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে গাড়িচালক আলাউদ্দিন ও রামপুরা থেকে আরেক গাড়িচালক রহিমকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলেও জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল ফারুক নিউজ বাংলাকে জানান, তিনটি পাসপোর্টের নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য মেহেদীর কাছ থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছিল তার বন্ধু আহসান, যিনি পাঁচ বছর মালয়েশিয়ায় থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন। ২০২০ এর মার্চ থেকে গুলশান ২ নম্বরের একটি রেস্তোরাঁয় মাসিক ৬৫ হাজার টাকা বেতনে এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে কাজ করছিলেন। তবে করোনা সংকটে রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়েন।
তখন স্ত্রীর আত্মীয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত আলাউদ্দিনের কাছে কিছু টাকা ধার চান। আলাউদ্দিন পেশায় গাড়িচালক হলেও পাসপোর্ট অফিসে দালালি ও পরিবহন পুলের পুরাতন গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আলাউদ্দিন আহসানকে টাকা ধার না দিয়ে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ দিতে বলেন। কথা হয়, এ কাজে যে টাকা পাওয়া যাবে দুজনে ভাগ করে নিবেন।
আহসান বাল্যবন্ধু মেহেদীকে জানান, পাসপোর্টে সমস্যা (নামের বানান সংশোধন, জন্ম তারিখ সংশোধন, বয়স বাড়ানো-কমানো সংক্রান্ত কোনো কাজ থাকলে সমাধান করে দিতে পারবেন। সময়মতো কাজ না হওয়ার একপর্যায়ে মেহেদী এ দুজনকে পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত না দিলে ঢাকায় এসে তাদের অফিসে অভিযোগ করবেন বলে হুমকি দেন। চাকরি হারানোর ভয়ে আহসান ও আলাউদ্দিন মেহেদীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আহসান ও আলাউদ্দিন পাসপার্ট নেওয়ার জন্য মেহেদীকে শনিবার (১০ অক্টোবর) ঢাকায় আসতে বলেন।
শনিবারই ঢাকা এসে রাত ১১টার দিকে ওঠেন আহসানের খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় ভাড়াবাসায়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাতের খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয় মেহেদীকে। রাত দেড়টার দিকে ঘুমন্ত মেহেদীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন আহসান। মোবাইল ফোনে আলাউদ্দিনকে হত্যার পর বিষয়টি নিশ্চিত করেন আহসান।
তারপর লাশ হাত-পা রশি দিয়ে বেধে বেডশিট, মশারি ও পলিথিনে মুড়িয়ে ফেলেন আহসান। এই ঘটনা দেখে ফেলেন পাশের কক্ষে থাকা সহকর্মী তামিম। আহসানের অনুরোধে তামিম জানান বিষয়টি কাউকে বলবে না; লাশ সুবিধাজনক স্থানে ফেলে দিতে সহায়তা করবেন।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছেন, লাশ সরিয়ে ফেলার জন্য রাত চারটার দিকে আলাউদ্দিন খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় আহসানের বাসায় গাড়ি পাঠান। আহসান ও তামিম চালককে গাড়িতে বসতে বলে নিজেরাই ‘মালামাল’ গাড়িতে তুলবে জানালে তিনি ‘মালামাল’ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। এছাড়া ফজরের নামাজ শেষ হওয়ায় লোক সমাগম বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি ছেড়ে দেয় আহসান।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, লাশ বিছানার নিচে রেখে রোববার দুপুর বারোটার দিকে রেস্তোরাঁয় যান আহসান ও তামিম। কাজ শেষে দুজন বাসায় ফেরেন। রাত একটার দিকে আলাউদ্দিনের নির্দেশে তার মাইক্রোবাস চালিয়ে খিলক্ষেতে আহসানের বাসায় যান রহিম। আহসান ও তামিম বিছানা, মশারি, বেডশিট ও পলিথিনে মোড়ানো মেহেদীর লাশটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে রহিমকে সায়েদাবাদে যেতে বলেন। পথে তামিম নেমে যান। হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্তে গাড়ি থামিয়ে লাশ পানিতে ফেলে দেন আহসান।
অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল ফারুক জানান, গ্রেফতারদের কাছে তিনটি পাসপোর্টে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার জন্য ব্যবহৃত মেহেদীর বাস টিকিট জব্দ করা হয়েছে। যে মাইক্রোবাসে করে মেহেদীর লাশ হাতিরঝিলে ফেলা হয় সেটিও জব্দ করা হয়েছে।
তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ বলেন, এটি ছিল একটি ক্লু লেস হত্যাকাণ্ড। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় যাতে সনাক্ত করা না যায় সেজন্য হাতের আঙ্গুল বিকৃতকরণের পাশাপাশি মুখমণ্ডলও বিকৃত করা হয়। লাশ যেখানে ফেলা হয়েছিল সেখান থেকে ৫০ মিটার দূরে একটি ছেড়া কাগজ পাওয়া যায়। তাতে লেখা একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে লাশের পরিচয় বের করা হয়। পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত চারজনকে গ্রেফতার ও সব আলামত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি আমরা।