দুর্গাপূজা সামনে রেখে পুরান ঢাকার শাখারীবাজার, তাঁতীবাজার, নর্থব্রুক হল রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় এখন প্রতিমা গড়ার ধুম। মজার কথা হলো, এসব প্রতিমার প্রায় সবই গড়ছেন পুরধাপ্রসাদের উত্তরসূরী তিন শিল্পী।
প্রায় একশ বছর আগে আশুলিয়ার শিমুলিয়ার নরবাড়িতে সবাই এক নামে চিনত প্রতিমা কারিগর পুরধাপ্রসাদ পালকে। তার ছেলেরা একসময় শহরমুখী হয়ে ঢাকায় থিতু হন। এখন পুরধাপ্রসাদের তিন নাতি হরিপদ পাল, বলাই পাল ও পল্টন পালের হাতেই গড়ে উঠছে পুরান ঢাকার বেশিরভাগ দুর্গা প্রতিমা।
হরিপদ পাল ও পল্টন পাল কাজ করছেন শাঁখারীবাজারে। আর বলাই পালের দেখা মিলবে নর্থব্রুক হল রোডের পুরনো জমিদার বাড়ির বড় বারান্দায়। এখান থেকেই তৈরি দুর্গা বসবে পুরান ঢাকার বিভিন্ন মণ্ডপে।
ছাঁচের উপর কাদামাটি দিয়ে দেবীর অবয়ব তৈরির কাজ এরই মধ্যে শেষ। এখন চলছে নিখুঁত করার কাজ। এরপর চলবে রঙ-তুলির টান।
নর্থব্রুক হল রোডের জমিদার বাড়ির বড় বারান্দায় প্রতিমার কাজ চলছে। ছবি: নিউজবাংলা
প্রায় ৩৭ বছর ধরে প্রতিমা গড়ছেন বলাই পাল। দাদু আর বাবার কাছে শেখা, সঙ্গে একনিষ্ঠ ভালোবাসা। ঠিক কবে থেকে কাজ শুরু মনে নেই, তবে সেই ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে প্রতিমা গড়ার টুকটাক চেষ্টা চোখে এখনো ভেসে বেড়ায়।
বলাই পাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মায়ের আশীর্বাদে প্রতিবছর প্রতিমা গড়ার বায়না বাড়ছে। এ বছর ১১টি প্রতিমার কাজ করছি।’
করোনার কারণে এবার পূজার আনুষাঙ্গিক আয়োজনের বাজেট ছাঁটলেও দেবী প্রতিমার খরচে কোনো কমতি রাখছে না আয়োজকেরা। ফলে গতবারের মতোই আছে শিল্পীর পারিশ্রমিক।
দুর্গা প্রতিমা তৈরি মানেই বিশাল কর্মযজ্ঞ। নদীপাড়ের পলিমাটির কোনো বিকল্প নেই। এর সঙ্গে মেশানো হয় বেলে এবং এঁটেল মাটি। খড়ের কাঠামোর ওপর সেই মাটিতে দৃশ্যমান হয় দেবী প্রতিমা। একদম শুরু থেকে রঙ শেষ করা পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় তিন মাস।
শাঁখারীবাজারে দিন-রাত ব্যস্ত হরিপদ পাল ও পল্টন পাল। ৭০ বছর ছুঁই ছুঁই হরিপদ নিজেও বলতে পারেন না কত বছর ধরে প্রতিমা গড়ছেন।
প্রতিমা কারিগর বলাই পাল। ছবি: নিউজবাংলা
দুর্গার মুখের আদল কীভাবে ঠিক হয়, কল্পনার সঙ্গে বাস্তব কোনো মুখ কি শিল্পীকে প্রভাবিত করে? নিউজবাংলার এমন প্রশ্নে শিল্পীরা জানান, কখনো কল্পনা, আবার কখনো আয়োজকদের ইচ্ছাকে মানতে হয় তাদের। ফলে রানি ভিক্টোরিয়া থেকে হাল আমলের ভারতীয় অভিনেত্রীদের মুখের আদলও অনেক সময়ে ছাপ ফেলে দুর্গার মুখে।
হরিপদ পাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না। মা যেভাবে চান সেইভাবেই আমাদের হাতে তার চেহারা ফুটে উঠে।’
তবে পল্টন পাল বলেন, ‘এখন ইচ্ছামতো মায়ের চেহারা ফুটিয়ে তুলতে পারি না। সব প্রতিমা আয়োজকদের ইচ্ছাতেই বানাতে হয়।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক মুকুল কুমার বাড়ই নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ অঞ্চলে প্রতিমা শিল্প মূলত কারিগরদের কল্পনাজাত সৃষ্টি। বংশ পরম্পরায় চলে আসা এই শিল্পে ফুটে ওঠে শিল্পীর ভাববোধ। তবে বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই ভাববোধের সঙ্গে বাস্তব দুনিয়ারও সংমিশ্রণ ঘটেছে।’
দুর্গাপূজা ছাড়াও বছরের অন্য সময়েও প্রতিমা শিল্পীদের চাহিদা রয়েছে। সনাতন ধর্মে বারো মাসে তের পার্বণ থাকায় সরস্বতী, লক্ষ্মী, কালিসহ অনেক প্রতিমা গড়তে হয় তাদের।
হরিপদ পাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় সারাবছর আমরা নানান পূজার প্রতিমা তৈরি করি। সারাবছর ধরেই তাই কাজ থাকে। তবে দুর্গাপূজার মৌসুমে ব্যস্ততা সবচেয়ে বেশি।’
নিবিড় ভালোবাসায় তৈরি প্রতিমা পূজার আগে চলে যায় মণ্ডপে। নিজের সৃষ্টিকে বিদায়ের মুহূর্তে ভারী হয়ে ওঠে শিল্পীর মন। পল্টন পাল বলেন,‘আয়োজকেরা প্রতিমাগুলো যখন নিয়ে যান, তখন যেন সব কিছু শ্মশান হয়ে যায়। আমার ঘর খালি করে দিয়ে দেবী চলে যান অন্য ঘরে। সে কষ্ট অনেক।’
পূজার উৎসব শেষে দেবী বিসর্জনে তৈরি হয় মন ভেঙে যাওয়ার অনুভূতি। তবে প্রতিবছর সেই কষ্ট বুকে চেপে রেখেই প্রতিমা শিল্পীরা তৈরি হন পরের বছরের দুর্গা গড়ার জন্য।