দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক দাবি করছে, তারা 'ব্যানকোভিড' নামে এমন একটি টিকা তৈরি করছে, যা কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সক্ষম। তারা বলছে, এই টিকা প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে প্রাণিদেহে অ্যান্টিবডি তৈরিতে সফল হয়েছে। সব ঠিক থাকলে চলতি মাসেই মানবদেহে করোনা ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু হতে পারে। আর বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসতে পারে জানুয়ারির মধ্যে।
গ্লোব বায়োটেকের বিজ্ঞানীরা ২ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে আসার কথা প্রথম জানান। সেই সময়ে তারা একটি খরগোশের ওপর টিকা প্রয়োগ করে ফলাফল দেখার অপেক্ষায় ছিলেন।
গ্লোব বায়োটেক আশা করছে, জানুয়ারিতে তাদের টিকা বাজারে আসবে। তবে প্রাণিদেহে পরীক্ষা শুরুর মাত্র সাত মাসের মধ্যে টিকা বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনা কতটা সম্ভব? অথবা একটি কার্যকর টিকা তৈরিতে প্রয়োজনীয় ধাপগুলো এ সময়ের মধ্যে অনুসরণ করা সম্ভব কিনা- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
প্রাণীর ওপর পরীক্ষার (প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) পর একটি সম্ভাব্য টিকার কার্যকারিতা সাধারণত তিন ধাপে মানুষের দেহে পরীক্ষা করতে হয়। প্রতিটি ধাপে কয়েক মাস সময় লাগার কথা। এর যে কোনো পর্যায়ে জটিলতা দেখা দেখা দিলে বাতিল হতে পারে যে কোনো ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট (সম্ভাব্য টিকা)।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্লোব বায়োটেক এখনও তাদের সম্ভাব্য টিকার গবেষণা পদ্ধতি সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করেনি। এখনও বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অথচ মানবদেহে কোনো টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আগে বিএমআরসির নৈতিক ছাড়পত্র (ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স) নেয়া বাধ্যতামূলক।
বিএমআরসির পরিচালক ডা. মাহমুদ উজ জাহান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্লোব বায়োটেকের টিকা মানব দেহে পরীক্ষার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এমনকি কোনো কাগজপত্রও আমরা পাইনি।‘
গ্লোব বায়োটেকের বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করছেন, বিএমআরসিকে তারা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাননি। প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও বিকাশ শাখার ইনচার্জ আসিফ মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছি। তাদের মাধ্যমে বিএমআরসির কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়া হবে।‘
তিনি বলেন, ‘টিকার ট্রায়ালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নিতে অনেক মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসরণ করে সব প্রক্রিয়া শেষেই মানবদেহে পরীক্ষা শুরু করবে গ্লোব বায়োটেক।‘
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, মানবদেহে টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কয়েকটি ধাপ রয়েছে। একেবারে শুরুতে অল্প কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর দেহে এটি প্রয়োগের পর সময় নিয়ে প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়। এটি সফল হলে দ্বিতীয় ধাপে বিভিন্ন বয়স ও স্বাস্থ্যের স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর প্রয়োগ করা হয় টিকা। তৃতীয় ধাপে, টিকা প্রয়োগ করা হয় দেশ-বিদেশের কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে। কোনো কোনো সময় একই প্রক্রিয়ায় চতুর্থ ধাপেও পরীক্ষা চালানোর প্রয়োজন পড়ে।
এই ধাপগুলো কবে, কীভাবে অনুসরণ করা হবে- সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য দেয়নি গ্লোব বায়োটেক।
তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল নিয়ে একটি নিবন্ধ আন্তর্জাতিক প্রি-প্রিন্ট সার্ভার ‘বায়ো আর্কাইভে’ প্রকাশিত হয়েছে। জীববিজ্ঞান বা চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোনো গবেষণার ফল দ্রুত তুলে ধরতে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এ ধরনের প্রি-প্রিন্ট সার্ভার ব্যবহার করে থাকেন।
গ্লোব বায়োটেকের সম্ভাব্য টিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসএমএমইউ-এর সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্লোব বায়োটেক আবেদন করলে ন্যাশনাল রিসার্চ এথিকস কমিটি প্রি-ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার ফলগুলো বিশ্লেষণ করবে। এর ভিত্তিতে ঠিক করা হবে, এটি মানবদেহে পরীক্ষার অনুমতি দেয়া হবে কি না। তবে গ্লোব জানুয়ারির মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে আসার যে দাবি করছে, তার ভিত্তি নেই। বিশ্বের কোনো প্রতিষ্ঠান মাত্র সাত মাসে ভ্যাকসিন বাজারে আনতে সক্ষম হয়নি।‘
চীনের সিনোভ্যাক্সের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই টিকা এখন পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে রয়েছে। যার অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশে পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ট্রায়ালটি শুরুতে দুই মাস চলার কথা ছিল। যেসব স্বেচ্ছাসেবী টিকা নেবেন তাদের ছয় মাস ফলোআপে রাখা হবে। যদি চীনের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপেই এতো সময় লাগে, তাহলে গ্লোবের ভ্যাকসিন কীভাবে এতো অল্প সময়ের মধ্যে বাজারে আসবে!’
কোভিড-১৯ টিকা উদ্ভাবনে চূড়ান্ত সাফল্য দাবি করছে রাশিয়া। দেশটির গামালিয়া ইনস্টিটিউট টিকা বাজারজাত শুরু করলেও সব ধাপ অনুসরণ না করায় সেটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
এর বাইরে কোভিড-১৯ টিকা উদ্ভাবনে বিশ্বজুড়ে ২০০টিরও বেশি গবেষণা চলছে। এর মধ্যে এগিয়ে আছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, জার্মানির বায়োটেক, চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিক্যাল, সিনোভ্যাক বায়োটেক এবং সিনোফার্ম।