ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে যে মৃত্যুদণ্ড একমাত্র দাবি নয়, সেটি মনে করিয়ে বাকিগুলোর বিষয়েও সরকারের ঘোষণা চেয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিসভা ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করে আইনের সংশোধনে সায় দিয়েছে। সংশোধিত আইন কার্যকর হবে মঙ্গলবার থেকেই। সংসদ অধিবেশনে না থাকায় আইনটি জারি হবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে। সংসদ বসলে সেটির অনুমোদন নেয়া হবে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনকারীরা বলেছেন, ঝুলে থাকা মামলার নিষ্পত্তিসহ উঠা অন্যসব দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা সোচ্চার থাকবেন। তবে সড়ক অবরোধ বা এই ধরনের কর্মসূচিতে আর না যাওয়ার কথাও বলেছেন তারা।
একাধিক রাজনৈতিক কর্মী ও শিক্ষার্থী বলেছেন, সর্বোচ্চ সাজার বিষয়টি ছাড়াও নারীর নিরাপত্তা নিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রসঙ্গ আছে। যেগুলো নিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্য আসা উচিত।
বর্তমান আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে দলগত ধর্ষণ বা ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হলে প্রাণদণ্ডের বিধান আছে। পাশাপাশি দণ্ডিতের অর্থদণ্ডের বিধান আছে।
তবে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারী নির্যাতনে ভিডিও ফাঁসের পর গড়ে উঠা আন্দোলনে আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করার দাবিটি প্রধান হয়ে উঠে।
ফাঁসির দাবি ছাড়াও শাহবাগের কর্মসূচিতে নয় দফা এবং উত্তরার কর্মসূচিতে সাত দফা দাবি জানানো হয়।
নয় দফা দাবি যাদের পক্ষ থেকে এসেছে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, আর সাত দফা দাবি যাদের পক্ষ থেকে এসেছে, তাদের মূল পরিচয়, তারা শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী নয়।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের একজন বলেছেন, তারা আগে থেকে যেসব দাবি জানিয়েছেন, তার সবগুলো যৌক্তিক নাও হতে পারে, তবে বেশিরভাগের পেছনেই যুক্তি আছে।
রাজনৈতিক কর্মীর প্রতিক্রিয়া
শাহবাগে আন্দোলন করা ছাত্র ইউনিয়নের কে সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি ছিল। সেগুলোর কী হবে? তাছাড়া আইনের মধ্যেই ধোঁয়াশা। সর্বোচ্চ শাস্তির খসড়া করছেন, সর্বনিম্ন শাস্তি কী? বিশেষ করে আমাদের যে প্রচলিত আইন সেখানে ১৮৭২ এর যে সাক্ষ্য আইন সেটা সংশোধনে আমরা বিশেষ জোর দিয়েছিলাম। সেটা কোথায়?’
নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের যে মামলাগুলো জমা হয়ে পড়ে আছে সেগুলো আগে নিষ্পত্তি করা হোক। তার আগ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন, কর্মসূচি চলবে।’
গত শুক্রবার শাহবাগে কর্মসূচিতে যে নয়টি দাবি জানানো হয়, তার মধ্যে আছে ঝুলে থাকা মামলা নিষ্পত্তিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইনের বিলোপ ও সংশোধন প্রভৃতি।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া
রাজধানীর উত্তরায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া প্লাটফর্ম ‘আমরাই বাংলাদেশ- রুখবো ধর্ষণ' এর আহ্বায়ক প্রিয়তা মণ্ডল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা খুশি যে তারা এটা অনুমোদন করেছেন। ধন্যবাদ জানাই তাদের। তবে, বলা হয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সেক্ষেত্রে সর্বনিম্ন কী? কিছু টাকা বা কয়েক বছরের জেল? তাই এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা মানববন্ধন আকারে আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
একই প্লাটফর্মের আরেক আহ্বায়ক লাবিব মুহান্নাদ বলেন, ‘আমাদের সাতটি দাবি ছিল। তারা একটি দাবি মানছেন, তাও পুরো না। আমাদের আরও ছয়টি দাবি আছে যেগুলো তারা আমলেই নেয়নি। তাই আমরা অবরোধ না করলেও মানববন্ধন করছি।’
মিরপুরে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ প্লাটফর্মে করা আন্দোলনের আয়োজকদের একজন মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী ইসমাইল অপূর্ব বলেন, ‘অত্যন্ত একজন আসামিকে এই শাস্তি মানে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এই আন্দোলন অব্যাহত রাখব। বাস্তবিকভাবে এর প্রয়োগ দেখেই আমরা ঘরে ফিরব।’
ধানমন্ডিতে 'ডেথ ফর রেইপ' ব্যানারে আন্দোলন করা সাধারণ শিক্ষার্থীর একজন সুপ্রিয় চাকমা বলেন, ‘আমরা আমাদের আন্দোলন তখনই স্থগিত করব যখন আমাদের দাবির অন্তত ৬০ শতাংশ মেনে নেয়। কারণ আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী। যা দাবি তার সবকিছু লজিক্যাল নাও হতে পারে। কিন্তু যেগুলো বাস্তবসম্মত, সেগুলো তো মেনে নিতে হবে।’
শাহবাগের আন্দোলনে উঠা দাবি
১. ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ‘ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধ ও বিচারে ব্যর্থ’ স্বরষ্ট্রমন্ত্রীকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে।
২.পাহাড়ে সমতলে আদিবাসী নারীদের উপর যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।
৩. সব প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে। সিডো সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে।
৪. ধর্মীয়সহ সকল ধরনের সভা-সমাবেশে নারীবিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞানে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে। পর্নোগ্রাফি নিযন্ত্রণে বিটিসিএল এর কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে।
৫. তদন্ত চলাকালে ভুক্তভোগীকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। তার আইনি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ট্রাইবুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে ঝুলে থাকা মামলা দ্রুত শেষ করতে হবে।
৭. ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন ১৮৭৯-১৫৫ (৪) ধারাকে বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।
৮. পাঠ্যবইয়ে নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছেদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দচয়ন বাদ দিতে হবে।
৯. গ্রামীণ সালিশে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে হবে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাত দাবি
১. দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে ধর্ষণের (সকল লিঙ্গের ক্ষেত্রে) সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে।
২. ধর্ষণের মামলা সুষ্ঠু নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অভিযোগ গ্রহণ থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে লিঙ্গভেদে নারী/পুরুষ কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে।
৩. বৈঠক/শালিসি পদ্ধতির মাধ্যমে ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে এবং ধর্ষণ মামলার বাদীর নিরাপত্তা ও চিকিৎসা প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।
৪. পূর্ববর্তী সব ধর্ষণের মামলা আগামী ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।
৫. ইভটিজিং,সাইবার বুলিংসহ সকল যৌন নির্যাতন বন্ধে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মরক্ষামূলক ও যৌন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সকল প্রিন্টেড ও ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রচার করতে হবে।
৬. দলীয়/প্রশাসনিক মহলের কেউ ধর্ষণের মতো অপরাধে প্রশ্রয় দিলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং মিথ্যা নারী, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলার মাধ্যমে কাউকে হয়রানি করা হলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৭. দাবিসমূহ নিশ্চিত করতে সরকার প্রধানকে লিখিত অঙ্গীকার দিতে হবে, দাবির যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে একটি কমিটি গঠন করতে হবে।