পদ্মার ইলিশ কথাটা এখন কম শোনা যায়। বাজারে এখন সবাই খোঁজেন চাঁদপুরের ইলিশ।
চাঁদপুর মেঘনায়। তবে পদ্মা-আর মেঘনার মিলনস্থলের খুব কাছে। ধরা পড়া ইলিশ মাছ বেশিরভাগ ওখানেই প্রথম নামে। ফলে চাঁদপুরের ইলিশই পদ্মার ইলিশ।
দীর্ঘ ২০ বছর ঢাকার কারওয়ান বাজারে মাছ বিক্রি করেন মোহাম্মদ বিল্লাল। তিনি বলছেন, চাঁদপুরের ইলিশের বেশি স্বাদ। কিন্তু এখন বাজারে চাঁদপুরের ইলিশ নেই। বরিশাল, ভোলাসহ সমুদ্রের কাছের জেলাগুলো থেকে আসা ইলিশ চাঁদপুরের ইলিশ বলে বিক্রি করছেন অধিকাংশ বিক্রেতা।
বিল্লাল বলেন, চাঁদপুরের ইলিশ বেশি তাজা। রঙ একটু বেশি চকচকে হয়।
ওই বিক্রেতার মতে, বরিশালের ইলিশও খারাপ না। তবে বাজারে তা চাঁদপুরের ইলিশ নামে চলে।
তিনি বলেন, ‘বরিশালের ইলিশও চকচকে হয়। তবে ঢাকার বাজারে আসতে সময় বেশি লাগে তাই রঙ কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়।‘
বিল্লাল আরো বলেন, ‘মাছের রঙ ভালো হলে আমরাই বরিশালের মাছ চাঁদপুরের ইলিশ বলে বিক্রি করি।‘
ইলিশ চেনায় দক্ষ লোকদের পরামর্শ: ইলিশ মাছ যে জায়গারই হোক ঘাড় মোটা, পেট একটু চাপা এবং ডিম ছাড়া ইলিশ কিনতে হবে। তাহলে মাছ খেয়ে মজা।
বাজারে এখন ইলিশের ছড়াছড়ি। বার্মিজ বা সার্ডিন ইলিশ বাজারে নেই। আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরা-বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে। মা মাছের ডিম পাড়ার সুবিধার্থে প্রতিবছর এই সময়ে ইলিশ ধরা সাময়িক বন্ধ রাখে সরকার।
কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন কামাল হোসেন। বর্তমানে আড়ত থেকে পাইকারি এনে আড়তের সামনের ফুটপাতে খুচরা ইলিশ বিক্রি করছেন।
কামাল হোসেন বলেন, চাঁদপুরের ইলিশ সব দিক দিয়ে গোল হয়। মাছ হাতে নিলে কিছুটা রাবারের মতো বাঁকা হয়ে যায়। কিন্তু চট্টগ্রামের ইলিশ কাঠের মতো শক্ত। ওই মাছগুলো স্বাদ হয় না।
কামাল হোসেনর মতে ডিমওয়ালা মাছ বা ডিম ছেড়ে দেওয়া ইলিশের স্বাদ কম। হালকা ডিমওয়ালা মাছও খেতে সুস্বাদু হয়।
কামাল হোসেনের ছেলে সবুজও মাছ বিক্রেতা। তিনি জানান, ডিম ছেড়ে দিলে মাছের পেট একেবারে পাতলা হয়ে যায়। তাছাড়া অন্যান্য মাছের মতো ইলিশ মাছ তাজা কিনা তা বোঝার জন্য গায়ের রং উজ্জ্বল এবং কানকা উঁচু করে দেখতে হবে ফুলকা লাল কিনা।
অনেকে মনে করেন, দোকানিরা ফুলকায় রঙ দিয়ে লাল করে রাখেন। কিন্তু কামাল জানান, ইলিশের ফুলকায় রঙ দিলেও তা থাকে না। ফলে ওটা গুজব।
এই বিক্রেতা জানান, বরিশালের ইলিশের পেটের মাঝখানে একটি লাল দাগ থাকে। চাঁদপুরের ইলিশের পেটে এমন দাগ থাকে না।
মাছ বিক্রেতা মো. বাসার জানান, তিনি ২৭ বছর মাছের ব্যবসা করেন। সর্বোচ্চ সাড়ে তিন কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি করেছেন।
তিনি বলেন, চাঁদপুরের ইলিশ ধরা পড়ার পরপরই সকালে লঞ্চে তুলে দেওয়া হয়। একটু তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসে। এ কারণে বেশি টাটকা থাকে। বেশি স্বাদ লাগে।
একই জায়গায় বসে মাছ বিক্রি করছেন মো. হানিফ নামের অল্পবয়স্ক এক বিক্রেতা। তিনি জানান, বাজারে বরিশাল ও ভোলার মাছ চাঁদপুরের বলে বিক্রি করা হচ্ছে। মাছ বেশিরভাগই আসে বরিশাল ও ভোলা থেকে। এ কারণে তাদের মাছ চেনার জন্য আলাদা কোনো বিশেষত্ব দরকার হয় না।
চাঁদপুরের ইলিশা আর ভোলার ইলিশের মধ্যে স্বাদের তফাৎ কেন হয়? আসলে এর মূলে আছে সাগরের ইলিশ আর নদীর ইলিশের তফাৎ।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নিয়ামুল নাসের নিউজবাংলাকে বলেন, সাগরের লবণ পানি থেকে মাছগুলো যতোই নদীর মিঠা পানিতে উঠে আসতে থাকে, ততই মিঠা পানিতে থাকা খাবার খেয়ে ইলিশের শরীরের মাংসপেশীর গঠনে পরিবর্তন আসে। এছাড়া সাগরে থাকার সময় মাছগুলোর সাঁতার কাটার প্রয়োজন কম পড়ে। যে কারণে মাছের শরীরে প্রচুর চর্বি জমে যায়। নদীতে এলে মাছগুলো সাঁতার কাটার সুযোগ পায়, চর্বি কমতে থাকে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে ইলিশ মাছ নদীতে আসার আগেই সাগর থেকে ধরে আনছেন জেলেরা। যে কারণে বাজারে নদীর মাছ পাওয়া যাচ্ছে কম। মাছের স্বাদও আর আগের মতো নেই।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ওই অধ্যাপক বলেন, কম চর্বিযুক্ত ইলিশ দেখে কিনতে হবে। তাছাড়া মা মাছের পেটটা একটু চওড়া হবে। উজ্জ্বলও হবে। এ ধরনের ইলিশ খেতে স্বাদ হয়। তবে বাজারে এখন বড় বড় যে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে এগুলো সবই সাগরের মাছ।