গণমাধ্যমকর্মী আরিফ হোসেনের পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয় গত ৫ আগস্ট। নমুনা পরীক্ষায় জানা যায় সবাই কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত।
আরিফের তীব্র শ্বাসকষ্ট থাকার কারণে ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। ১৫ দিন পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন তিনি। বাকি সদস্যরা বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু আরিফের দেখা দেয় নতুন সমস্যা: আগের মতো কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না তিনি। মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ। একটু পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়াসহ শরীরে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে।
মুজাহিদ নামের আর একজন বেসরকারি চাকরিজীবী কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে সহজেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু এরপর স্মৃতিভ্রমের সমস্যা দেখা দিয়েছে তার। অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছেন। আগের অনেক স্মৃতি মনে করতে কষ্ট হচ্ছে। সকালে একটি কাজের পরিকল্পনা করলেও দুপুরে এসে সেই পরিকল্পনার কথা মনেই করতে পারছেন না।
আরিফ বা মুজাহিদের মতো অনেকের মধ্যে দেখা দিচ্ছে করোনাপরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী নানান সমস্যা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে যারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন, তাদের একটা বড় অংশের শরীরে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই এটা ঘটছে। চিকিৎসকেরা এটার নাম দিয়েছেন ‘লং কোভিড’।
লং কোভিড নিয়ে বিশ্বজুড়েই চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। চিকিৎকেরা বুঝতে চেষ্টা করছেন এটির গতিপ্রকৃতি: কারা এতে আক্রান্ত হচ্ছেন, উপসর্গের তালিকাটি কী।
কয়েকজন চিকিৎসক বলেছেন, একেক ব্যক্তির শরীরে একেক রকম উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, পেশী ব্যথা, শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, মাথা ব্যথা, গন্ধ এবং স্বাদ হ্রাস এবং সেইসাথে হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, কিডনিতে ক্ষত তৈরি হচ্ছে । এমন সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে থাকলে করোনা থেকে মুক্তি পেয়েও মৃত্যুর ঝুঁকি রয়ে যাচ্ছে।
ইতালির একটি হাসপাতালে ১৪৩ জন রোগীর ওপর পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এ।
এতে দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কোভিড থেকে সেরে ওঠার দুই মাস পরও অন্তত একটি উপসর্গ থেকে গেছে। অর্ধেকের বেশি রোগীর মধ্যে স্থায়ীভাবে থেকে গেছে অবসাদ। ৪০ শতাংশের বেশি রোগী বলেছে, তারা দু মাস পরও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। ২৫ শতাংশ ভুগছেন অস্থিসন্ধির ব্যথায়।
যুক্তরাজ্যে ৪০ লাখ মানুষের ব্যবহার করা “কোভিড সিস্পটম ট্র্যাকার অ্যাপ” নামে একটি অ্যাপের পরিসংখ্যান বলছে, সেরে ওঠার ৩০ দিন পরও ১২ শতাংশ লোকের মধ্যে নানারকম উপসর্গ থেকে গেছে। সেরে ওঠার ৯০ দিন পরও ২ শতাংশ লোক লং কোভিডের উপসর্গে ভুগছে।
ডাবলিনে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখে গেছে, কোভিড থেকে সেরে ওঠা প্রায় অর্ধেক সংখ্যক ব্যক্তি দশ সপ্তাহ অবসাদে ভুগেছেন। এক-তৃতীয়াংশ লোক সেরে ওঠার পরও অফিসে যোগ দিতে অক্ষম ছিলেন।
মানসিক পরিবর্তন
যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত আরেকটি গবেষণা আরো উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। ‘অ্যানালস অফ ক্লিনিকাল অ্যান্ড ট্রান্সলেশনাল নিউরোলজি’ নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল বলছে, কোভিড থেকে সেরে ওঠা রোগীদের এক-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে মানসিক কার্যক্রমে পরিবর্তন ঘটেছে। অনেকের মধ্যে ঘোর বা মানসিক বিকার দেখা দিয়েছে। অনেকের মানসিক প্রতিক্রিয়ার বা সাড়া প্রদানের ধরনে পরিবর্তন ঘটেছে।
কী বলছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা
কোভিড-পরবর্তী উগসর্গ নিয়ে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণার তথ্য পাওয়া যায় নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম নিউজ বাংলাকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ সুস্থ হওয়ার পরও কিছু ব্যক্তির শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আমরা রোগীদের বলছি, হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিলেও কমপক্ষে দু মাস চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
‘শরীর বা মানসিক কোনো পরিবর্তন হলেও ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এমন ঘটনাও আমরা পেয়েছি, যেখানে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়ার পর রোগীর আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে।‘
বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকেরা এখনও নিশ্চিত কিছু জানতে পারছেন না উল্লেখ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. বিল্লাল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, এ নিয়ে উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, আমরা রোগীকে পরামর্শ দিচ্ছি করোনা ভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার পরেও দুই মাস চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে চালবেন এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করবেন। ব্যায়ামসহ নিয়মের ভেতরে থাকতে হবে।