বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের রাশ টানতে চায় সরকার

  • অরুণ কর্মকার, কন্ট্রিবিউটর রিপোর্টার   
  • ৮ অক্টোবর, ২০২০ ১২:২২

দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে ২৯টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে সরকারের পর্যালোচনার বিষয় হবে ২৬টি প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমাতে চায় সরকার। এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এখন তা বাস্তবায়নের পথ খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন করতে হলে পরিকল্পনায় থাকা ২৬টি প্রকল্প বাতিল করতে হবে সরকারকে। এগুলোর কতটি বাতিল করা সম্ভব হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।  

এ সম্পর্কে সরকারি সূত্রগুলো একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে, যা-ই করা হোক, তা বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনা (পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান বা পিএসএমপি) পর্যালোচনা করে সংশোধনের মাধ্যমে করা হবে।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে পুরোপুরি সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়নি। আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি, কীভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে আনা যায়।’

সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রধান কারণ হচ্ছে, কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী তেল-গ্যাসের দাম কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা আর সস্তা জ্বালানি বিকল্প নয়। আমদানি করা কয়লার এখন দাম বেশি। নৌপথ ও বন্দরের সীমাবদ্ধতার কারণে কয়লা আমদানির প্রক্রিয়া ঝুঁকিপূর্ণ। সেই সঙ্গে নবায়নযোগ্য বিকল্পের ব্যয় ক্রমশ কমে আসছে।

বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে মোট ২৯টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্প-পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এবং মাতারবাড়ি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যালোচনার আর সুযোগ নেই। কারণ, পায়রা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষে চালু হয়েছে। রামপাল বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মাতারবাড়ি প্রকল্পের কাজও অর্ধেকের বেশি শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পটি শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নয়। এর সঙ্গে রয়েছে একটি কয়লার টার্মিনাল নির্মাণ এবং সমুদ্র থেকে এই টার্মিনাল পর্যন্ত কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলের উপযোগী একটি খাল খনন। এই কাজগুলোর বাস্তবায়ন অনেকটাই এগিয়েছে।

তাই সরকারের পর্যালোচনার বিষয় হবে অবশিষ্ট ২৬টি প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট। সরকারি সূত্র বলছে, এগুলোর মধ্যেও এমন কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে যেগুলো পর্যালোচনার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। যেমন ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পায়রা দ্বিতীয় পর্যায়; দেশীয় প্রতিষ্ঠান রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) এবং চীনের নরিনকোর যৌথ উদ্যোগে পায়রার পাশেই বাস্তবায়নাধীন ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি প্রকল্প, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাস্তবায়নাধীন ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রকল্প প্রভৃতি।

এই প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন এবং ইপিসি (ইরেকশন, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদার নির্ধারিত হয়ে আছে। এ ধরনের প্রকল্প বাতিল করতে গেলে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এসব প্রকল্পের বিনিয়োগকারী এবং ইপিসি ঠিকাদারেরা চুক্তির ‘ফোর্স মেজার্স’ ও বিমা ক্লজের আওতায় ক্ষতিপূরণ দাবি করবে। আরও কিছু প্রকল্পে ইকুইটি বিনিয়োগ হয়েছে। সেগুলো বাতিল করতে গেলেও সরকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তবে কিছু প্রকল্প আছে যেগুলো বাতিল করার সুযোগ রয়েছে।

প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার যে প্রকল্প সরকার পর্যালোচনা করতে চায় বলে জানা যাচ্ছে, তার মধ্যে ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রকল্পে বিনিয়োগকারী ও ইপিসি ঠিকাদার হচ্ছে চীনা কোম্পানি। আর ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট প্রকল্পের সঙ্গে আছে জাপানি কয়েকটি কোম্পানি।

চীনা কোম্পানিগুলোর মধ্যে পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অফ চায়না ৬ হাজার মেগাওয়াট; চায়না এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ৪ হাজার মেগাওয়াট; (চীনের) ফার্স্ট নর্থ-ইস্ট ইলেকট্রিক পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট; চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট এবং চায়না হুয়ানদিয়ান ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রকল্পের বিনিয়োগকারী ও ইপিসি ঠিকাদার।

এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া মহেশখালী এলাকায় কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগে সমঝোতা স্মারক সই করেছে। এগুলো বাতিল করা অবশ্য অপেক্ষাকৃত সহজ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্বালানি খাতের পর্যবেক্ষকদের মতে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপক হারে কমানোর সরকারি উদ্যোগ এসব বিনিয়োগকারীদের জন্য, বিশেষ করে চীন ও জাপানি বিনিয়োগকারীদের বিশেষ দুশ্চিন্তার বিষয় হবে। এ বিষয়টি উপেক্ষা করে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে না। সুতরাং সরকার শেষ পর্যন্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কতটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সরকারের এই নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী তা আনুমোদন করলে মন্ত্রণালয় বা তার অধীনস্ত কোনো সংস্থা বা একটি কমিটি গঠন করে কোন কোন প্রকল্প বাতিল করা যায় এবং তার ফলে সরকারকে কী দায়দায়িত্ব নিতে হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হবে। তাদের সুপারিশ সরকার অনুমোদন করলে তখন তা বাস্তবায়ন করা হবে। 

কোভিড-১৯ জনিত বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ একই উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত জুন মাসে পাকিস্তান ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক কাসিম প্রকল্প বাতিল করেছে। ভিয়েতনাম বেশ কিছু প্রকল্প বাতিল করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে। ভিয়েতনাম এনার্জি ইনস্টিটিউট সে দেশের সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, আগামী এক দশকের মধ্যে চালু হওয়ার মতো ৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়েকটি প্রকল্প এবং ২০৩০ সালের মধ্যে চালু হওয়ার প্রক্রিয়াধীন ৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাতিল করার। এই অঞ্চলের প্রধান কয়লা সরবরাহকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া তাদের কয়লা খনির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপক হারে কমিয়ে আনা সরকারের জন্য যথেষ্ঠ জটিল বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।

তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম মনে করেন, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারকে বিশেষ কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। কারণ সরকার যে প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করতে চায় সেগুলোর একটিও এমন স্তরে নেই যে তা বাতিল করলে সরকারকে কোনো দায় নিতে হবে।

ম. তামিম বলেন, ২০১০-১১ সালে মূলত কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। তার ওপর তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় কয়লা ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার দেশীয় কয়লা ব্যবহারের পথে অগ্রসর হয়নি। আর প্রয়োজনীয় বন্দরের অভাব ও অগভীর  সমুদ্রের কারণে আমদানি করা কয়লা দিয়ে সাশ্রয়ী দামে ২০/২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন তখনও অসম্ভব বিবেচনা করা হয়েছে। এখনো হচ্ছে।

ম. তামিম বলেন, এখন বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গেছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণের বৈশ্বিক উদ্যোগের কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর ক্রমশ চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে গ্যাসের দাম কমেছে। ধারণা করা হচ্ছে, পরিবেশের দায়সহ আমদানি করা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের তুলনায় আমদানিকৃত এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বেশি হবে না। সুতরাং সেই পথই যুগোপযোগী।

এ বিভাগের আরো খবর