করোনা পরিস্থিতিতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী জাবেদ হাসান সুজন। ঋণ হয় কয়েক লাখ টাকা। ব্যবসা নেই, কিন্তু ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে পাওনাদার, শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি। নিজের ওপর হারিয়ে ফেলেন নিয়ন্ত্রণ।
পুলিশ জানায়, গত ৩০ সেপ্টেম্বর দোকান থেকে বাসায় ফিরে মেয়ে ও ছেলেকে ছুরিকাঘাত করেন। এরপর নিজেও গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন জাবেদ।
তিন জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পর সাত বছরের মেয়ে জারিন হাসান রোজা মারা যায়। বেঁচে যান জাবেদ ও তার ১৫ বছরের ছেলে সাকিব হাসান রিজন। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।
গত ১ অক্টোবর স্বামী জাবেদ হাসানকে আসামি করে হাজারীবাগ থানায় মামলা করেন স্ত্রী শারমিন আক্তার রিমা।
জাবেদ হাসানের এমন আচরণের কারণ হিসেবে দুটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত করছে পুলিশ। এক. করোনায় ব্যবসায়িক ক্ষতি, দুই. জাবেদের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক।
সুজনের ভাই মেহেদি হাসান রিংকু নিউজবাংলাকে জানান, তার ভাইয়ের কাপড়ের দোকান ছিল। তিনি ভারত থেকে কাপড় আনতেন। করোনায় তার বিক্রি কমে যায় এবং বেশ কয়েক লাখ টাকা ঋণ হয়।
পুলিশ বলছে, হাজারীবাগে এক নারীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক ছিল জাবেদের। তা নিয়ে কয়েক দফা সালিশও হয়।
তবে ওই নারীর সঙ্গে এখন আর সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন সুজনের ভাই রিংকু। তিনি বলেন, ‘গত ছয় সাত মাস আগে এই সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।’
মামলায় এই বিষয়টি অবশ্য উল্লেখ করেননি জাবেদের স্ত্রী রিমা। তিনি লেখেন, ব্যবসায় লোকসান ও ধার-দেনা হওয়ার কারণে আগের দোকান ছেড়ে দিয়ে বাসার নিচে আরেকটি দোকান খুলেন জাবেদ। তখনও পাওনাদাররা টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছিল। এ নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তিত থাকতেন জাবেদ।
নিয়মিত পরিবারের সবাইকে গালাগালি করতেন এবং দুই সন্তানকে বলতেন, ‘তোদের জন্যই আমার এত এত ঋণ, তোরা মরতে পারিস না?’
তদন্তের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার আব্দুল্লা হিল কাফি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসামি কথা বলার মতো সুস্থ না হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। তার ৬-৭ লাখ টাকা ঋণ ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আমরা সবগুলো বিষয় সামনে রেখেই তদন্ত করছি।’
যেভাবে হত্যা
বাদী রিমার বর্ণনা অনুযায়ী জাবেদ ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে আগের দোকানের মালামাল বর্তমান দোকানে নিয়ে আসেন। এ সময় ছেলে রিজন বাবার সঙ্গেই ছিল।
জাবেদ দুপুর দেড়টায় বাসায় এসে গোছল করেন। ছেলে বাসায় আসে দুপুর দুইটায়। খাওয়া-দাওয়া করে জাবেদ মেয়েকে নিয়ে ঘুমাতে যান। ঘুম থেকে উঠে যান দোকানে।
বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে রাগান্বিত হয়ে বাসায় ফেরেন জাবেদ। রিমা দেখেন জাবেদ তার দুই সন্তানকে মারধর করছেন।
তখন ছেলে রিজন বলছিল, ‘আমি কী দোষ করছি, শুধু তো বৃষ্টিতে গোসলই করছি, আমাকে মারছ কেন?’
জাবেদকে মারতে নিষেধ করেন স্ত্রী রিমা। কিন্তু ফেরাতে পারেননি। তখন শাশুড়িকে ডেকে আনতে যান। কিন্তু জাবেদ দরজা বন্ধ করে দেন।
এরপর কার্টার (কাগজ কাটার কাজে ব্যবহৃত) দিয়ে মেয়ে রোজার হাত ও গলায় উপর্যুপরি আঘাত করেন। রিমা মেয়েকে জাপটে ধরে জাবেদকে ফেরাতে যান।
জাবেদ তখন ছেলে রিজনকে ধরে তার হাতে ও গলায় ক্রমাগত আঘাত করেন। এরপর নিজের গলায় আঘাত করেন।
রিমা দরজা খুলে চিৎকার করলে তার মেঝ দেবর মেহেদী হাসান রিংকু ও আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। তারা তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যায়।
শ্বাসনালি কেটে যাওয়া ও প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে মারা যান রোজা।
জাবেদ ও তার ছেলে সাকিব হাসান বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের ৩০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তাকে পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে।