বেগমগঞ্জ নির্যাতনের ঘটনায় নাম আসা দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করেনি দাবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুন উর রশীদের।
অথচ দেলোয়ারকে গ্রেফতার করা র্যাব-১১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম দুটি হত্যা ও দুটি চাঁদাবাজি মামলার তথ্য দিয়েছেন।
ওসি হারুন মামলার তথ্যও জানেন না। এতদিন দেলোয়ারের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থাও নেননি।
ঘরে ঢুকে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন দেলোয়ার বাহিনীর কাজ বলে জানিয়েছে র্যাব। তাহলে ওসি হারুন কেন কিছু জানেন না, এ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
সোমবার বেগমগঞ্জ ঘুরে বেশ কিছু মানুষের বক্তব্য শুনে এটা স্পষ্ট যে, দেলোয়ার এলাকায় এক ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছেন। র্যাবও এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সেই সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে সখ্যের অভিযোগও আছে।
স্থানীয়রা জানান, দেলোয়ারের বেড়ে উঠা অভাব-অনটনের মধ্যে। কয়েক বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর চালানো শুরু করেন অটোরিকশা।
সেই দেলোয়ার এখন বেশ বিত্তশালী। তার রয়েছে একটি মাছের খামার। ঠিকাদারদের মাটি, বালু সরবরাহের কাজ করে থাকেন। এর সবই হয়েছে ২০১৪ সালের পর।
অর্থ বানালেও দেলোয়ার নিজের ঘর তোলেননি। তিনি গৃহহীনদের জন্য ঘর তুলতে সরকারের যে প্রকল্প আছে, সেখান থেকে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছিলেন।
নির্যাতনের ঘটনায় যে নয় জনের নামে মামলা হয়েছে, তারা সবাই দেলোয়ারের দলবল বলে পরিচিত। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, এই সংখ্যাটি আসলে ৫০ থেকে ৬০ জন। এদের কারণে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে সেখানে।
ভুক্তভোগী নারীও বলছেন, দেলোয়ারের অনুসারীদের ভয়েই তিনি গত এক মাসেও পুলিশের কাছে অভিযোগ করেননি। পুলিশ নিজে গিয়ে নিয়ে আসায় সাহস পেয়েছেন।
স্থানীয় কয়েক জন জানান, ২০১৩ সালের দিকে দেলোয়ার রাজনীতিতে জড়ান; অটোচালকের পরিচয় ঘুঁচিয়ে এলাকায় হয়ে উঠেন প্রভাবশালী।
ওই বছরে তিনি যোগ দেন যুবলীগের রাজনীতিতে। এক পর্যায়ে পরিচিত হয়ে উঠেন ইউনিয়ন কৃষক লীগ সভাপতি আলমগীর কবির ভূঁইয়া আলো ও জহিরের আস্থাভাজন কর্মী হিসেবে।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় উঠতি বয়সের যুবকদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘কিশোর গ্যাং’।
গ্যাংয়ের প্রধান সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকায় কাজ করেন বাদল ও কালাম। সোমবার দিনভর বেগমগঞ্জ ঘুরে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি, মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায়সহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে মোহাম্মদ আলী ও রবিন নামের দুই যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেখানেও এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত ছিল বলে অভিযোগ আছে।
নির্যাতনের শিকার গৃহবধূর এক প্রতিবেশী জানান, ওই রাতে ঘটনা ঘটিয়ে এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়ায় দেলোয়ার বাহিনী।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে এক প্রতিবেশী বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। দেলোয়ার ও হেতার লোকের বিরুদ্ধে ডরে আমরা কাউরে কিছু কই নঁ। হেতারা সরকারি দলের নেতা, কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ যুবলীগের। হেতাগো আছে ইয়াবা বেচনের নগদ টেঁয়া, অস্ত্র। হেতারা নেতা, এমপিগো লগে ছবি উডায়। আমরা হেতেগো কী করমু?’
বাহিনীর বিরুদ্ধে গত ছয় মাসে এলাকায় একাধিক নারীকে লাঞ্ছনার অভিযোগ আছে। তবে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি।
একলাশপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফিরোজ আলম ভুঁইয়া বলেন, ‘এই ধরনের (সন্ত্রাসী) কর্মকাণ্ডে সে জড়িত আছে এবং থানায় তার বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে।’
‘আপনারা এতদিন কিছু বলেননি কেন?’ এমন প্রশ্নে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা আর কী বলব? পুলিশের তো তাদের ধরার কথা। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকায় পুলিশ তাদের ধরে না। আমরা তো পুলিশের ওপর খবরদারি করতে পারি না। এখন না এই ঘটনার কারণে এগুলো ফুটে উঠেছে।’
দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা বলে পরিচয় দেন। নেতা এমপিদের সঙ্গে ছবি দিয়ে ব্যানার থাকায় পুলিশও তাদের সমীহ করে চলে বলে অভিযোগ আছে।
এখলাশপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা কামাক্ষা চন্দ্র দাস বলেন, ‘দেলোয়ার ও তার গ্যাংয়ের সদস্যরা দলের পরিচয়ে এলাকায় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, খুন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ করে আসছে।’
জনাব দাস বলেন, ‘আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদ আলী ও রবিন নামের তাদের দলের দুই যুবককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, হত্যাসহ একাধিক মামলা থাকলেও সরকারি দল করায় তাদের পুলিশ গ্রেফতার করছে না।’
তবে বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুন উর রশীদ এসবের কিছুই জানেন না। নিউজবাংলার এক প্রশ্নে তিনি জানান, দেলোয়ারের বিরুদ্ধে থানায় কোন মামলা রয়েছে কি না তা এই মুহূর্তে তিনি বলতে পারবেন না। তবে তার বিরুদ্ধে অন্য কোনো অপরাধে ইতিপূর্বে কোনো অভিযোগ করেনি কেউ। করলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।
দেলোয়ারকে গ্রেফতারের পর সোমবার নারায়ণগঞ্জে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব-১১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম বলেন, দেলোয়ার বাহিনী ওই এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত।
‘দেলোয়ার এলাকায় অস্ত্রধারী চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তাদের ভয়ে এলাকার লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত।’