নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের প্রতিবাদে সোচ্চার সারা দেশ। পুলিশ, র্যাবও তৎপর হয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান আসামি ও তাদের মদতদাতা হিসেবে পরিচিত একজনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে।
এর আগে গ্রেপ্তার দুই আসামিকে নেয়া হয়েছে রিমান্ডে। বাকিদেরও আদালতে তোলার প্রস্তুতি চলছে।
গত ২ সেপ্টেম্বর বেগমগঞ্জে ওই নারীর বাড়িতে ঢুকে তাকে নির্যাতন করে ভিডিও ধারণ করা হয়। রোববার সে ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সারাদেশ, আর তাৎক্ষণিক অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বেগমগঞ্জ থেকে রোববারই আবদুর রহীম ও রহমত উল্লাহ নামে দুই জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রোববার গভীর রাতে আরেক অভিযুক্ত মো. দেলোয়ার হোসেনকে পিস্তল, ম্যাগাজিন ও গুলিসহ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। আর দেলোয়ারের তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার ভোরে ঢাকার কামরাঙ্গীর চর থেকে গ্রেফতার হন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ওরফে বাদল।
নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্তে সোমবার বিক্ষোভ হয়েছে। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে সাধারণ মানুষ।
দুই আসামি রিমান্ডে
নোয়াখালীর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক মাসফিকুল হক বিকেলে দুই আসামি আব্দুর রহিম ও রহমত উল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে পাঠান। পুলিশ তাদের সাত দিন হেফাজতে নেয়ার আবেদন করেছিল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বেগমগঞ্জ থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তাক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দেলোয়ার বাহিনীর কাজ: র্যাব
মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ওরফে বাদল ও মদতদাতা দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব।
নারায়ণগঞ্জে র্যাব-১১ কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম জানান, এই ঘটনা বেগমগঞ্জের দেলোয়ার হোসেনের বাহিনী ঘটিয়েছে। দেলোয়ারের বিরুদ্ধে এর আগে হত্যার দুটি এবং চাঁদাবাজির দুটি মামলা আছে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম জানান, দেলোয়ারকে রোববার গভীর রাতে একটি পিস্তল, ম্যাগাজিন ও দুটি গুলিসহ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
পরে দেলোয়ারের তথ্যের ভিত্তিতে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের একটি প্লাস্টিকের কারখানা থেকে গ্রেফতার করা হয় মামলার প্রধান আসামি বাদলকে।
বাদলকে হস্তান্তর করা হয়েছে বেগমগঞ্জ থানায়।
র্যাব জানায়, দেলোয়ার বাহিনী ওই এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত।
উচ্চ আদালতে তীব্র প্রতিক্রিয়া
সকালে বিচারপতি মো.মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চে বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন দুই জন আইনজীবী।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘এ ঘটনা মানবতার ওপর জঘন্যতম অপরাধ। আপনারা এটি ফলোআপে রাখেন।’
আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘এ ঘটনায় আমাদের সমাজের ওপর প্রভাব পড়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদাহানি হয়েছে।’
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এ ঘটনায় শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বিদেশেও মানুষ দেখতে পেয়েছে।’
শুনানি শেষে নির্যাতিতা নারী ও তার পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
পাশাপাশি ভিডিওটি ফেসবুক থেকে সরিয়ে দিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগীর বক্তব্য গ্রহণে পুলিশের অবহেলা আছে কি না- অনুসন্ধান করতে কমিটি করে দিয়েছে হাইকোর্ট। কমিটিকে ২৮ অক্টোবর প্রতিবেদন দিতে হবে।
প্রতিবাদ-বিক্ষোভ
বেগমগঞ্জ নির্যাতনের প্রতিবাদ হয়েছে সারাদেশে। রাজধানীর উত্তরা ও শাহবাগে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ হয়েছে। নারীদের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র গঠনে কঠোর ভূমিকার ডাক এসেছে।
বিক্ষোভে এই ঘটনার পাশাপাশি দেশজুড়ে ঘটা ধর্ষণের প্রতিবাদ জানানো হয়। উত্তরায় বিক্ষোভ শেষে দুই মাসের মধ্যে ধর্ষণ মামলা নিষ্পত্তি, ধর্ষকদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডসহ সাত দফা দাবি জানানো হয়।
শাহবাগে কয়েকটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ও ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’ প্ল্যাটফর্মে প্রতিবাদকারীরা সমবেত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্রদল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত নোয়াখালীর সুবর্ণচরের শিক্ষার্থীরা আলাদা ব্যানারে মানববন্ধন করেন।
মামলায় যা অভিযোগ
আগের রাতে বেগমগঞ্জ থানায় দুটি মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী; একটি নির্যাতনের ঘটনায় এবং একটি পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে। আসামি করা হয় নয় জনকে।
আসামিরা হলেন বাদল, মো. রহিম, আবুল কালাম, ইস্রাফিল হোসেন, সাজু, সামছুদ্দিন সুমন, আবদুর রব, আরিফ ও রহমত উল্যা। তাদের সবার বাড়ি বেগমগঞ্জে।
ওই নারী জানান, নির্যাতন করে তাকে বলা হয়, ঘটনা ফাঁস করলে প্রাণে মেরে ফেলা হবে। তাকে কুপ্রস্তাবও দেয়া হয়। বলা হয়, রাজি না হলে ভিডিওটি ফেসবুকে ফাঁস করে দেয়া হবে। পরে তাই করা হয়।
নোয়াখালীর পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন বলেছেন, নির্যাতনের ঘটনায় নয় জনকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের সবাইকে ধরতে অভিযান চলছে। দ্রুত জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।