সংসারের অভাব মেটাতে লিবিয়া যেতে চেয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবের জানু মিয়া। তবে কার মাধ্যমে কীভাবে যাবেন জানা ছিল না। এজন্য গ্রামের যারা বিদেশ গেছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন।
এক পর্যায়ে একজন খবর দেন- ভৈরবেরই সোহাগ ও শ্যামল লিবিয়ায় লোক পাঠাচ্ছেন; লাগবে চার লাখ টাকা।
গ্রামের সেই লোককে বিশ্বাস করে অনেক কষ্টে পুরো টাকাই জোগাড় করেন জানু মিয়া। এরপর তার মাধ্যমে ওই টাকা পাঠিয়ে দেন একদম অপরিচিত সোহাগ ও শ্যামলের ব্যাংক হিসাবে।
কথা ছিল লিবিয়ায় ভালো কাজ পাবেন জানু মিয়া। তবে গত ৩০ সেপ্টেম্বর শরীরে পাঁচটি গুলি নিয়ে দেশে ফিরেছেন ৩২ বছরের এই যুবক।
লিবিয়ার মিজদা শহরে গত ২৯ মে মানব পাচারকারীদের বর্বরোচিত হামলায় জানু মিয়াসহ আহত হন ১২ বাংলাদেশি; প্রাণ যায় ২৬ বাংলাদেশির।
বর্বরোচিত ওই ঘটনার পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি আহতদের দেশে ফেরাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ফিরে আসেন জানু মিয়াসহ ৯ জন।
লিবিয়া থেকে ফিরে আসা জানু মিয়াসহ ৯ বাংলাদেশিমৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে দেশে ফিরতে পারা বাকিরা হলেন ফিরোজ বেপারী, ওমর শেখ, সজল মিয়া, তরিকুল ইসলাম, বকুল হোসেন, মো. আলী, সোহাগ আহমেদ ও সাইদুল ইসলাম। এই আটজনের বাড়ি বিভিন্ন জেলায়।
রোববার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে তাদের নিয়ে হাজির হন কর্মকর্তারা। সেখানে জানু মিয়া লিবিয়া যাওয়া ও সেখান থেকে ফিরে আসার নির্মম কাহিনী তুলে ধরেন।
জানু মিয়া বলেন, জানুয়ারির ১ তারিখে তারা বাংলাদেশ থেকে যাত্রা করেন। সোহাগ ও শ্যামলের লোকেরা তাদের ঢাকা থেকে কলকাতা; এরপর মুম্বাই হয়ে দুবাই, দুবাই থেকে মিশর ও মিশর থেকে লিবিয়ার বেনগাজী যাওয়ার টিকিট করে দেন।
বেনগাজী পৌঁছার পর জানু মিয়াদের স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করে। ভালো কাজের কথা বলা হলেও তাকে দেয়া হয় ‘অনেক কষ্টের কাজ’; যে কাজের কথা তিনি নিউজবাংলাকে বলতে চাননি। জানু মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, তারা ৩০ জন বাংলাদেশি ছিলেন যারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো কাজের আশায় লিবিয়া পাড়ি জমিয়েছিলেন।
তিনি জানান, বেনগাজী পৌঁছানোর পর তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু হয়। চুক্তি অনুযায়ী কাজ না দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। এভাবে তিনমাস তারা বেনগাজীতে ছিলেন। এরপর ‘অনেক কষ্টের সেই কাজ’ দেয়া হয় নামমাত্র বেতনে। সিআইডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন লিবিয়া ফেরত জানু মিয়া
জানু মিয়া বলেন, এমন পরিস্থিতিতে তারা দালাল সোহাগ ও শ্যামলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। তারা বলেন, ‘ভালো কাজ’ পেতে হলে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি যেতে হবে। এজন্য আরও ৬০ হাজার করে টাকা দিতে হবে। এই টাকা নিতে সোহাগ আর শ্যামলের লোকেরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
তিনি জানান, ত্রিপোলি যেতে রাজি না হলে তাদের আবারও বেশি টাকা বেতনের চাকরির আশ্বাস ও জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। আরও পড়ুন: লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যায় জড়িতদের দেশে আনার চেষ্টা
জানু মিয়া বলেন, ‘বেনগাজীতে যে কাজের পারিশ্রমিক ৫০ ডলার, ত্রিপোলিতে তা ৬০-৭০ ডলার। তাই আমরা শেষ পর্যন্ত ত্রিপোলি যেতে রাজি হই। একটা গাড়িতে ৩০ জন বাংলাদেশি ত্রিপোলি পৌঁছাই।
‘সেখানে পৌঁছানোর পরপরই আমাদের সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। স্থানীয় মাফিয়ারা আমাদের জিম্মি করে ১০ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে। বলে, বাঁচতে চাইলে ওই টাকা দিতেই হবে।’
জানু মিয়া জানান, একটি গাড়িতে থাকা অবস্থায় তাদের আটক করা হয়। একজন গাড়িতে লুকিয়ে থাকায় বেঁচে যান। বাকি ২৯ জনকে নিয়ে একটি ঘরে তিনদিন বন্দি রাখা হয়। সেখানে পানি ছাড়া কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি। সেখানে আগে থেকে আরও ৯ বাংলাদেশি ছিলেন।
‘সেখানে আফ্রিকার একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে রাখা হয়েছিল। তার লাশ দেখিয়ে মাফিয়ারা বলত টাকা না দিলে তোদেরও পরিণতি হবে এমন।
‘এরপর প্রতিদিন আমাদের নির্যাতন করত মাফিয়ারা। আরা বলত, টাকা না দিলে মেরে ফেলবে। এক পর্যায়ে ২৯ মে তাদের গুলিতে আমাদের চোখের সামনে মারা যান ২৬ বাংলাদেশি। লাশগুলো ডাস্টবিনে ফেলে রাখা হয়, আমাদেরও সেই ডাস্টবিনে রাখা হয়।’
জানু মিয়া জানান, পরে লিবিয়ার সেনাবাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে তাদের ১২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইওএম’র মাধ্যমে জানু মিয়াসহ ৯ জন ৩০ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরেন। আহতদের মধ্যে বাপ্পী দত্ত, সম্রাট খালাসী, সাজিদ এখনো আছেন লিবিয়ায়।
এক প্রশ্নের জবাবে জানু মিয়া বলেন, তিনি সোহাগ ও শ্যামলকে কোনো দিন দেখেননি। এলাকার যারা আগে লিবিয়া গেছেন তাদের মাধ্যমে এই দুজনের কথা জেনেছিলেন।