পথকুকুরদের নিয়ে সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন খোদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রেডিওতে তাঁর 'মন কী বাত' অনুষ্ঠানে মোদি দেশবাসীকে পরামর্শ দিয়েছেন দেশি কুকুর পালন করার। আত্মনির্ভর ভারত গড়তে বিদেশি কুকুরের বদলে দেশি কুকুর পালনে প্রধানমন্ত্রীর এ পরামর্শ আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে।
তবে কলকাতা শহরে পথকুকুরদের নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। টলিউডের তারকা থেকে শুরু করে বিশিষ্টদের বড় একটি অংশ নিয়মিত ব্যস্ত থাকেন পথকুকুর পরিচর্যায়। আবার উল্টো ছবিরও দেখা মেলে। কলকাতা করপোরেশনে কান পাতলেই শোনা যায় কুকুর নিয়ে হাজারো অভিযোগ নাগরিকদের মধ্যে।
কলকাতা পৌর এলাকায় অন্তত দেড় লাখ পথকুকুর আছে। সংখ্যাটি বেড়েই চলেছে। কলকাতা করপোরেশনের সাবেক মেয়র তথা বর্তমান প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছেন, কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তারা বন্ধ্যাকরণ অভিযান চালাচ্ছেন নিয়মিত। তবে সেটা যে প্রয়োজনের তূলনায় অনেকটাই কম, মেনে নিচ্ছেন ফিরহাদ। করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ এজন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করছে বলেও জানান তিনি।
কলকাতা পৌরসভার সাবেক ডেপুটি মেয়র তথা বর্তমান পুরপ্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য অতীন ঘোষের হাতেই কলকাতার স্বাস্থ্য বিভাগের ভার। আর পথকুকুরদের বড় ধরনের আস্তানা সরকারি হাসপাতাল।
গত বছর কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিষ খাইয়ে ১৬টি কুকুর ছানাকে হত্যা করার ঘটনায় গোটা শহর জুড়ে তোলপাড় ওঠে। তদন্তে উঠে আসে, হাসপাতালের নার্সিং স্টুডেন্টরাই হত্যা করেছে কুকুর ছানাগুলিকে। এতে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নেয় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। তারকা ব্যক্তিত্বরা পথে নামেন কুকুর হত্যার প্রতিবাদে।
তবে হাসপাতালগুলিতে পথকুকুরের বিচরণ বন্ধ হয়নি। এমনকি, সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডেও দিব্যি রাজত্ব করছে কুকুরেরা। বেড়েই চলেছে তাদের সংখ্যা। পৌরসভার বন্ধ্যাকরণের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ প্রসঙ্গে অতীন ঘোষ জানান, 'বন্ধ্যাকরণের কাজ চলছে। হাসপাতালগুলির ওপর রয়েছে বিশেষ নজরদারি। পুরসভার পশু চিকিৎসকেরা নিয়মিত নজরদারি চালাচ্ছেন পথ কুকুরদের ওপর।'
কলকাতাবাসীদের একপক্ষ পথকুকুরের চরম বিরোধী। প্রায়ই তাঁরা অভিযোগ জানায়, কুকুর নিয়ে সমস্যার কথা বলে। সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জানান, পথকুকুর রাস্তাঘাটে মলত্যাগ করে বলে বহু মানুষ তাঁর কাছে অভিযোগ জানিয়েছে। তাই তিনি পৌরসভাকে পরামর্শ দিয়েছেন, কুকুরদের মলত্যাগের জন্য শহরের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু পার্ক নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। তাতে সমস্যা অনেকটা মিটবে।
রাজ্য রাজনীতিতে শোভনের বিপরীত মেরুর সিপিএম নেতা মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীরও একই অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কুকুরের সমস্যা শুনতে শুনতে কান একেবারে ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির পোষা কুকুরকেও রাস্তা এবং খেলার মাঠে লোকে মলত্যাগ করায়। তার জন্য পাড়ার ফুটবল মাঠে আমাদের পোস্টারও মারতে হয়েছে।’
ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের চেয়ারম্যান দেবজয় ঘোষের দাবি, পথকুকুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতেই সমস্যা বাড়ছে। আরও ভালোভাবে কুকুরের জন্মনিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এছাড়াও পথকুকুরদের ডাকে নাকি অনেকের ঘুম ভেঙে যায়।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, রাতের আঁধারে বা ভোরের নরম সূর্যালোকে হাঁটাচলা করতে অসুবিধায় ফেলছে কুকুরের দল। তবে উল্টো ছবিটাও রয়েছে। বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী এবং তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায় বহুদিন ধরেই কুকুরদের নিয়ে কাজ করছেন।
বিশেষ করে পথকুকুরদের নিয়ে। লকডাউনের সময় আরও অনেক তারকা এগিয়ে এসেছেন কুকুরের সেবায়। শ্রীলেখা মিত্রকেও দেখা যাচ্ছে ইদানিং পথকুকুরদের খাওয়াতে। নিয়মিত তারা পথকুকুরদের খাবার দিয়ে থাকেন। রয়েছে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। তারাও নিয়মিত পরিচর্যা করেন কুকুরদের। বহু পাড়ায় এখন রান্না করা খাবার পরিবেশন করছে কুকুরপ্রেমীরা।
তরুণ আইনজীবী দেবলীনা বিশ্বাস সম্প্রতি সামাজিক গণমাধ্যম থেকে জানতে পারেন একটি কুকুর গাড়ি দুর্ঘটনায় জখম হয়েছে। খবর পেয়ে তিনি ছুটে যান শহর থেকে অন্তত ৭৫ কি.মি. দূরে নদিয়ার চাকদায়। সেখানে আহত কুকুরটির চিকিৎসা করানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করেন তিনি। আবার মাঝরাতে কলকাতার পাশেই হাওড়া শহরে এক মদ্যপ গাড়ি চাপা দিয়ে পিষে মারে একটি কুকুরকে। স্থানীয় মানুষ সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদে নামেন। পুলিশ বাধ্য হয় মদ্যপকে গ্রেফতার করতে।
ভারতের মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডের মানুষদের কাছে কুকুরের মাংস জনপ্রিয়। এদের যারা কলকাতায় থাকেন, তারা চোরাগোপ্তা কুকুর শিকার করেন বলে অভিযোগ বহুদিনের। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ থেকে কুকুর চোরাপথে পাচার হয় এই দুই রাজ্যে। সম্প্রতি দুটি রাজ্যেই কুকুরের মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দু-একজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিদ্রোহ শুরু হয়েছে দুই রাজ্যেই।
নাগারা মনে করেন, কুকুরের মাংস খাওয়া তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তবু দুই রাজ্যের সরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে রাজি নয়।
কলকাতায় পথকুকুরদের নিয়ে কাজ করছে ‘ফাউন্ডেশন ফর এনিম্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজ’। সংস্থার এমডি রজত চক্রবর্তী জানান, কলকাতার কুকুর আসলে করপোশনের সম্পত্তি। এখন পথকুকুরদের পরিচর্যার কাজে পৌরসভার পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এগিয়ে আসছেন। কিন্তু প্রয়োজনের তূলনায় সেটা অনেক কম। রজতের মতে, পথ কুকুরদের বন্ধ্যাকরণ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেটা নিয়ম মেনে করাতে হবে। না হলে উল্টো ফল হতে পারে। তাঁদের ফাউন্ডেশন নিয়মিত কুকুরের পরিচর্যা করে। এছাড়াও রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কলকাতার ইস্টার্ন বাইপাসের ধারে কুকুরদের জন্য চিকিৎসালয়ও গড়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, 'পথকুকুর বা দেশি কুকুরদের নিয়ে কলকাতার মানুষদের দয়া-মায়া কম। ফ্ল্যাট কালচারের মানুষেরা পছন্দ করেন না পথকুকুরদের। তবে ইদানিং ছবিটা বদলাচ্ছে। তবে মফঃস্বলের মানুষ চিরকালই দেশি কুকুরের ভক্ত।'