বরগুনায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ১০ আসামির মধ্যে সাত জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে দণ্ডবিধির ৩৪ ও ৩০২ ধারায়। এই ধারার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।
এই সাত আসামির বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র ও একজোট হয়ে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ এরই মধ্যে সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেছে।
বাকি তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের পালাতে সহযোগিতা করার। দণ্ডবিধির ১২০ বি ১ ধারায় আনা এই অভিযোগেও সরাসরি অপরাধে জড়িতদের যে শাস্তি হবে, সেটাও হতে পারে তাদের।
বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করা হবে বরগুনার একটি আদালতে। গত সোমবার রায়ের তারিখ ঘোষণা করেছেন বিচারক।
বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ মো. আসাদুজ্জামান মিয়ার আদালতে গত ১ জানুয়ারি শুরু হয় বিচার কাজ। শুনানি শেষ হয় ১৬ সেপ্টেম্বর।
গত বছরের ২৬ জুন রিফাত শরীফকে প্রধান সড়কে ঘিরে ধরে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও প্রকাশ পায়। পরদিন রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও পাঁচ-ছয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
মামলায় নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দীকা মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী রাখা হয়। ২ জুলাই ভোরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন প্রধান আসামি নয়ন বন্ড।
তবে তদন্তে ঘটনায় নাটকীয় মোড় আসে। প্রকাশ পায় প্রধান সাক্ষী নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নিও ঘটনার সঙ্গে জড়িত, যদিও ভিডিওতে তিনি তার স্বামীকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন বলে প্রকাশ পায়।
ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর পুলিশ মিন্নিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।
প্রাপ্তবয়ষ্ক ১০ জন ও কিশোর ১৪ জনের আলাদা বিচার শুরু হয়। অপ্রাপ্তবয়ষ্কদের বিচার চলছে শিশু আদালতে।
প্রাপ্তবয়ষ্কদের অভিযোগপত্রে মিন্নিকে ৭ নং আসামি রাখা হয়।
৪৩ কার্যদিবসে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৭৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য এবং যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।
১০ আসামি হলেন রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজী, আল কাইউম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান, মো. মুসা, আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি, রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মো. সাগর ও কামরুল ইসলাম সাইমুন।
হত্যায় সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে
নয়ন বন্ড কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের পর মামলার প্রধান আসামি রাকিবুল হাসান রিফাত ওরফে রিফাত ফরাজী। গত ৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
ফরাজীর বিরুদ্ধে হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত নয়ন বন্ডের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত। এলাকায় চুরি, ছাত্রাবাসে চাঁদাবাজি ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
২০১৯ সালে মার্চ মাসে ‘বন্ড ০০৭’ নামে একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খোলা হয়। রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার আগের রাতে এই গ্রুপেই হত্যার নির্দেশনা দেয়ার তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপের সবাইকে ২৬ জুন বুধবার সকাল নয়টার মধ্যে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে আসার নির্দেশনা দেয়া হয়। মোহাম্মদ নামে একজনকে আসার সময় রাম দা নিয়ে আসতেও বলা হয়।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ঘেঁটে দেখা যায়, রিফাত শরীফ কলেজ থেকে বের হওয়ার পর তাকে প্রথম কলার ধরেন রিফাত ফরাজী। দুই হাতে দুটি রামদা নিয়ে এসে কোপাতে শুরু করেন নয়ন। রিফাত শরীফের ওপর হামলার ছবি
রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আগেও ভাঙচুর, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং মাদক বিক্রিসহ নানা অপরাধে মোট আটটি মামলা রয়েছে। একাধিকবার গ্রেফতারও হয়েছেন। জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে আবার সন্ত্রাসে জড়ানোর অভিযোগ আছে।
দুই নং আসামি আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি ওরফে রাব্বি আকন আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন। তিনি বুড়িরচর ইউনিয়নের পশ্চিম কেওড়াবুনিয়া এলাকার আট নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
প্রধান আসামি রিফাত ফরাজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাব্বি। তিনিও বন্ড গ্রুপের অন্যতম সদস্য। পুলিশ জানিয়েছে, রিফাত হত্যার পরিকল্পনা ও ঘটনাস্থলে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তার।
অভিযোগপত্রে আছে, ঘটনার আগের দিন রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি রাব্বি আকনকে জানান রিফাত ফরাজী।
ঘটনার দিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে রিফাত কলেজে রওয়ানা হলে সে খবর রিফাত ফরাজীকে মুঠোফানে জানান রাব্বি।
সকাল সোয়া নয়টায় রিফাত কলজে ঢুকলে এবং সায়েন্স ভবনের পাশে অবস্থান নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন এই আসামি। পরিকল্পনা অনুযায়ী রিফাত কলেজ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে ধরে মারধর করতে থাকেন রাব্বি।
হামলার সময় যেন পালাতে না পারে, সে জন্য অন্য আসামিদের সঙ্গে রাব্বি আকনও রিফাতকে ঘিরে রাখেন।
হত্যার পর নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর সঙ্গে রাব্বির একাধিকবার মোবাইল ফোনে কথোপকথনের প্রমাণ আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ।
অভিযোগ গঠনের পর রাব্বি আকন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
এই মামলার তিন নং আসামি মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত। পুলিশ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বন্ড গ্রপের অন্যতম এই সদস্যও হত্যার আগের দিন করা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
রিফাত কলেজ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিফাতও তাকে ঘিরে ধরেন এবং রামদা আনতে দৌঁড়ে যান। রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ড যখন রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছিলেন, তখন নিহত রিফাতকে ঘিরে রাখেন সিফাত।
আগে থেকে তিনটি মামলার আসামি সিফাতের বিরুদ্ধেও এলাকায় নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে। রিফাত শরীফ
মামলার চতুর্থ আসামি রেজোয়ান আলী খান। তিনি স্থানীয়ভাবে টিকটক হৃদয় নামেও পরিচিত।
পুলিশ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রিফাত শরীফ কলেজ থেকে বের হওয়ার পর পর অন্যরা যখন তাকে টানতে টানতে সামনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কলেজের পূর্ব দিকে রাখা রাম দা আনতে যান রেজোয়ান। ফিরে এসে নিহত রিফাত শরীফকে ঘিরে রাখেন এই আসামি।
২০১৯ সালের ১ জুলাই গ্রেফতার করা হয় তাকে। তার বিরুদ্ধে হত্যার পরিকল্পনা ও সরাসরি অংশ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
রিফাত শরীফ কলেজ থেকে বের হওয়ার পরপর তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া ও কোপানোর সময় ঘিরে রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে হাসানের পাঁচ নং আসামি বিরুদ্ধেও।
২০১৯ সালের ১ জুলাই গ্রেফতার করা হয়েছে এই আসামিকে।
ছয় নং আসামি মুছা বন্ড এই মামলার একমাত্র পলাতক আসামি। বাড়ি বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ি এলাকায়। তিনিও বন্ড গ্রুপের অন্যতম সদস্য।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে মুছার বিরুদ্ধে।
অভিযোগপত্রে মূল পরিকল্পনাকারী ও হত্যার কারণ হিসেবে সাত নং আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে উল্লেখ করা হয়েছে।
ষড়যন্ত্র ও সরাসরি হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে এই তরুণীর বিরুদ্ধে। মিন্নি ও নয়ন বন্ড মিলে এই হত্যার পরিকল্পনা করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মিন্নি প্রথমে নয়নকে বিয়ে করেন। বিষয়টি গোপন রেখে বিয়ে করেন রিফাত শরীফকে। তবে নয়ন বন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক চালু থাকে। এ নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নির দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
হত্যার আগের দিন মিন্নি, নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীসহ অন্যরা সরকারি কলেজের শহীদ মিনারের কাছে বৈঠক করেন। সেখানেই হত্যার ষড়যন্ত্র হয় বলে আদালতকে জানিয়েছে পুলিশ।
গত বছরের ১৬ জুলাই গ্রেফতার হন মিন্নি, ২৯ আগস্ট তাকে জামিন দেয় উচ্চ আদালত। ৩ সেপ্টেম্বর কারাগার থেকে মুক্ত হন তিনি। এই মামলার জামিনে থাকা একমাত্র আসামি তিনি।
আসামিদের ‘পালাতে সহযোগী’ তিনজন
বাকি তিন আসামি রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মো. সাগর ও কামরুল ইসলাম সাইমুনের বিরুদ্ধে আসামিদের পলাতে সহায়তা ও আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এনেছে পুলিশ। অভিযোগ গঠন করা হয়েছে ১২০ বি ১ ধারা।
এরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলেও আসামিদের আশ্রয় দিয়ে পালাতে সহায়তা করেছেন বলে জনিয়েছে পুলিশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইমুন ও রাফিউল ইসলাম রাব্বির সহায়তায় ঘটনার পর পালিয়ে যান নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী।
বন্ড গ্রুপের সদস্য হিসেবে সাগর হত্যার পরিকল্পনায় যুক্ত হয়ে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে ভিক্টর সূচক চিহ্ন দেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
রাব্বি ও সাগরকে গতবছরের ১ জুলাই গ্রেফতার করে পুলিশ। সাইমুনকে একই বছরের ৩০ জুন গ্রেফতার করা হয়।