ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পোস্ট অপারেটিভ কক্ষে একটি শয্যার পাশে ফ্লোরে বসে একমনে ডিমের সাদা অংশ ও কুসুম আলাদা করে বাটিতে রাখছেন খোদেজা বেগম; নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে দগ্ধ ছেলে শেখ ফরিদকে খাওয়াবেন বলে। ডাক্তার বলেছেন, ডিমের সাদা অংশ খাওয়াতে হবে, কুসুম বাদ৷
দুর্ঘটনায় ছেলের আহত হওয়ার কথা শুনে সাড়ে সাত বছর ধরে পালা ছাগল বিক্রি করে টাকা নিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে এসেছেন খোদেজা। আদরের ছেলেকে যেকোনো মূল্যে সুস্থ দেখতে চান তিনি।
'ডাক্তার সাব কইছেন ডিম খাওয়াইলে ভালা অইব আমার পোলার। বেশি কইরা ডিম খাক, তাও আমার পোলাডা সুস্থ হোক'-চোখের পানি মুছতে মুছতে বলছিলেন খোদেজা।
২১ বছর বয়সী সন্তান শেখ ফরিদের অবস্থা সঙ্গীন। পুড়েছে শরীরের ৯৩ শতাংশ। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মী। গফরগাঁও সরকারি কলেজে পড়াশোনা করেন। ফতুল্লার মসজিদে বিস্ফোরণে জীবনটা হয়ে গেছে দুর্বিসহ।
ছেলের বাঁচা মরার সন্ধিক্ষণে। মায়ের আশা, তার কোলে ফিরবে পরম যত্নে বড় করা দায়িত্বশীল সন্তান।
পরিবারে পাঁচ ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় ফরিদ। বাড়ি কিশোরগঞ্জ। বাবা কাঁচামালের ব্যবসায়ী। এর মধ্যে চাকরি নিয়ে পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টায় ফরিদ। দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি এক বোনকে বিয়ে দিয়ে নিজের সংসার গড়ার সিদ্ধান্ত তার।
খোদেজা বেগম বলেন, 'দুই বইনরে বিয়া দিয়া ছোডডার লাইগা টেহা জমাইতাছিল আমার পোলাডা। কত কইছি বাপজান তুই একটা বিয়া কর। একটা বউ আন বাইত (বাড়িতে)। আর অহন আমার পোলাডার চানমুখটায় পুইড়া গেছে।'
মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে থাকা ৩০ বছর বয়সী ইমরানের পুড়েছে ৯৬ শতাংশ। পাশে দাঁড়িয়ে ফুপু ফেরদৌসি বেগম। নিশব্দে কাঁদছেন আর আঁচলে চোখ মুছছেন।
ইমরান পোশাক শ্রমিক। স্ত্রী আর সাত বছর বয়সী একমাত্র ছেলেকে নিয়ে মসজিদের পাশে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন।
'আমার এই ভাতিজা আছিল আমার আব্বার মতো৷ একইরকম চেহারা। খাড়া নাক। আল্লাহ এমন গজব দিল, চেহারায় কোনোটা নাক কোনটা মুখ বুঝা যাইতাছে না'-বাবার মতো চেহারাটা আর দেখতে পারবেন না বলে আরও বেশি কাঁদছিলেন ফেরদৌসী।
ফতুল্লায় মসজিদে বিস্ফোরণের পর পর যে ৩৭ জনকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে আনা হয়, তাদের মধ্যে ২৪ জন মারা গেছেন রবিবার বিকাল পর্যন্ত। কিছুক্ষণ পর পর আসছে মৃত্যুর খবর।
চিকিৎসাধীনদের স্বজনরা উৎকণ্ঠিত। কেউ ইউনিটের ভেতরে, কেউ বাইরে বারান্দায় অপেক্ষায়; একটি ভালো খবর চান সবাই।
তবে চিকিৎসক ভরসা দিচ্ছেন না। ১৩ জনের অবস্থাই সংকটাপন্ন-বলছেন বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল। জানান, ১৩ জনের মধ্যে ৬ জনকে আইসিউতে রাখা হয়েছে। তাদের শরীর তুলনামূলক কম পুড়লেও বেশিরভাগেরই শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের নিয়ে নিজেরাই শঙ্কিত।
চিকিৎসাধীন যার যা অবস্থা
ওয়ার্ড সুপারভাইজার রুকসানা আফরিনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ১৩ জনের মধ্যে ছয় জনকে রাখা হয়েছে পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে। আর সাধারণ ওয়ার্ডে এক জন।
আইসিউতে থাকা ফরিদের পুড়েছে ৫০ শতাংশ; মনিরের ৯০, আজিজের ৪৭, আব্দুল সাত্তারের ৭০, কেন্নালের ৩০ আর আমজাদের ২৫ শতাংশ।
পোস্ট অপারেটিভে থাকা ১৮ বছর বয়সী সিফাতের শরীর পুড়েছে সবচেয়ে কম, ২২ শতাংশ। হান্নানের ৮৫, শেখ ফরিদের ৯৩, আবুল বাশারের ৯৭, ইমরানের ৯৬ এবং নজরুলের ৯৪ শতাংশ।
সাধারণ ওয়ার্ডে থাকা মামুনের পুড়েছে সবচেয়ে কম, ১২ শতাংশ। তাকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি আশাবাদী বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন।
বাকিদের বিষয়ে শঙ্কিত এই চিকিৎসক। বলেন, ‘কারও ৮০ শতাংশ, কারও ৯০ শতাংশ বার্ন। কেউ আবার কম বার্ন তবে, গুরুতর জায়গা যেমন শ্বাসনালী বার্ন হওয়ায় অবস্থা বেগতিক।‘