রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতা শহরে। ১৮৬১ সালে। কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। ১৯৯৯ সালে। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪১ সালে, নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে নির্বাক হয়ে যান ১৯৪২ সালে। তারা সাতচল্লিশের দেশভাগ দেখেননি। পাকিস্তান রাষ্ট্র দেখেননি। স্বাধীন বাংলাদেশও না। তারা দেখেছেন পূর্ববঙ্গ। দু’জনেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে ছুটে এসেছেন পূর্ববঙ্গে। এই ভূখণ্ডের নানা জায়গায় ঘুরেছেন। দু’চোখ ভরে দেখেছেন পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি ও মানুষকে। এই ভূখণ্ড ছিল দু’জন সৃজনশীল মানুষের অবলোকনের আরাধ্য ভূমি। এই ভূমি থেকে তারা দু’হাত ভরে নিয়েছেন শিল্পের উপাদান। গড়েছেন সাহিত্যের জমিন। আর এই ভূখণ্ডও তাদের দিয়েছে অমরত্বের শ্রেষ্ঠ আসন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম শিলাইদহে আসেন ১৪ বছর বয়সে। সঙ্গী হয়েছিলেন পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সময়টি ছিল ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাস। ১৯ ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামপুর বোয়ালিয়ার ব্রহ্মামণ্ডলী আয়োজিত প্রার্থনা সভায় যোগ দেন। প্রশান্ত কুমার পাল তত্ত্ববোধিনী মাঘ সংখ্যার সূত্র ধরে লিখেছেন ‘স্বাধ্যায়ের পর প্রধান আচার্য্য মহাশয়ের কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুমধুর স্বরে একটি মনোহর ব্রহ্মসঙ্গীত করেন।’ এই সময়ে শিলাইদহে অল্প দিন অবস্থানের কারণে শিলাইদহ তার মনে তেমন দাগ কাটেনি।
তিনি দ্বিতীয় বার শিলাইদহে যান ১৮৭৬ সালে। সঙ্গী হয়েছিলেন বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সেবার তিনি শিলাইদহে একমাসের বেশি সময় কাটিয়েছিলেন। এ সময় তিনি কবিতা লিখে খাতা ভরিয়েছেন। ঘোড়ায় চড়ে ঘুরেছেন। ফুলের রঙিন রস কলমের নিবে লাগিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। তিনি ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন: ‘একলা থাকার মন নিয়ে আছি। ছোট একটি কোণের ঘর, যত বড় ঢালা ছাদ তত বড় ফলাও আমার ছুটি। অজানা ভিন দেশের ছুটি, পুরোনো দিঘার কালো জলের মতো তার থই পাওয়া যায় না। বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই, উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই। এইসঙ্গে আমার খাতা ভরে উঠতে আরম্ভ করেছে পদ্যে।’
কাজী নজরুল ইসলাম ১৫ বছর বয়সে পূর্ববঙ্গে আসেন। ১৯১৪ সালে। পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহর সহযোগিতায় তিনি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার কাজীরশিমলা গ্রামে আসেন। নদী-বিধৌত পূর্ববঙ্গ তার মানসপটে স্থায়ী ছাপ ফেলে। দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কাজীরশিমলা থেকে পাঁচ মাইল হেঁটে তিনি স্কুলে যেতেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃজন’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ঐ স্কুলের সহকারী শিক্ষক মহিমচন্দ্র খাসনবীশ নজরুলদের ইংরেজি পড়াতেন। তার বিবরণীতে জানা যায়, নজরুল ক্লাসে একটু অন্যমনস্ক থাকতেন এবং কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে প্রথমে একটু ঘাবড়ে যেতেন কিন্তু প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করলে নজরুল যথাযথ উত্তর দিতেন। ঐ বছর মহিমবাবুর পরিচালনায় দরিরামপুর স্কুলে একটি বিচিত্রানুষ্ঠান হয়, তাতে নজরুল রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ এবং ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতা দুটি আবৃত্তি করে সকলকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন।’ এই স্কুলে এক বছর পড়ার পরে তিনি আবার বর্ধমানে নিজ গ্রামে ফিরে যান।
এই এক বছরে কিশোর নজরুলের মনে পূর্ববঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রবলভাবে দাগ কাটে। তাকে প্রায়ই দেখা যেত ঠুনিভাঙা বিলের ধারে। দেখা যেত গাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন। এভাবেই সৃজনশীল প্রতিভার মানস গঠনে পূর্ববঙ্গ এক হয়। পূর্ণ করে তার সৃজনশীলতার মাত্রা। প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র বিস্তৃত হয় সাহিত্যের ক্যানভাসে রঙে ও সৌন্দর্যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করেন পূর্ববঙ্গের যশোর জেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের মেয়ে ভবতারিণীকে। ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। বিয়ের পরে তিনি স্ত্রীর নাম রাখেন মৃণালিনী। বিয়ের অনুষ্ঠান হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন: ‘মা গায়ে হলুদের পরে রবিকাকাকে আইবুড়োভাতের নেমন্ত্রন্ন করে। মা খুব খুশি, একে যশোরের মেয়ে, তায় রথীর মা মার সম্পর্কের বোন।’ বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘কবির কথা’ বইয়ে লিখেছেন: ‘এই প্রস্তাব স্বীকৃত হইলে মহর্ষি দক্ষিণডিহির বাড়িতে নানাবিধ খেলনা, বসনভূষণাদি কর্মচারী সদানন্দ মজুমদারের সঙ্গে পাঠাইয়াছিলেন। সদানন্দ মহর্ষির কথানুসারে গ্রামে নানা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করাইয়া কন্যার ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।’
রবীন্দ্রনাথের জীবনসঙ্গী গ্রহণের পর্বটি সম্পন্ন হয় ভালো ভাবেই। পূর্ববঙ্গের মেয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে উজ্জ্বলতম সন্তানটির জীবনে ঠাঁই নেয়। দু’জনে মিলে পাড়ি দেন অনেক পথ। জন্মগ্রহণ করে পাঁচটি সন্তান। এক সময় থেমে যান পূর্ববঙ্গের জলহাওয়ায় বড় হওয়া ভবতারিণী। এগিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উঠে যান দীর্ঘ পথ পার হয়ে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে।
স্কুল পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা ও ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে কলকাতায়। ১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম তার আমন্ত্রণে কুমিল্লা জেলার দৌলতপুর গ্রামে বেড়াতে যান। কিশোরবেলায় ময়মনসিংহ থেকে চলে যাওয়ার পরে এটি ছিল পূর্ববঙ্গে তার দ্বিতীয় বার আসা।
কুমিল্লায় পৌঁছে তারা শহরে আলী আকবর খানের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে কয়েকদিন থাকেন। বীরেন্দ্রর মা বিরাজসুন্দরী লেখালেখি করতেন। নজরুলের সঙ্গে তার হৃদ্যতা হয়। এই পরিবারের আতিথেয়তা নজরুলকে মুগ্ধ করে। এরপরে তারা দৌলতপুরে যান। গ্রামের প্রকৃতি তার কবিতায় উঠে আসে। তিনি অনেক কবিতা লেখেন। তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে সেসব কবিতা সংকলিত হয়।
দৌলতপুরে থাকার সময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে আকবর আলী খানের ভাগ্নী সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে। কবি তার নতুন নামকরণ করেন- নার্গিস আসার খানম। একই বছরের ১৮ জুন তাদের বিয়ে হয়। নার্গিস পরিবারের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে তিনি দৌলতপুর ছেড়ে চলে আসেন। কুমিল্লায় সতেরো দিন থাকেন। চারটি গান রচনা করেন। এ সময় শহরজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার বইছিল। নজরুল কুমিল্লার রাস্তায় মিছিলে যোগ দিয়েছেন। ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এল’ গানটি গেয়েছেন। ড. রফিকুল ইসলাম তার ‘জীবন ও সৃজন’ গ্রন্থে প্রাবন্ধিক আবদুল কুদ্দুসের লেখা উল্লেখ করেছেন: ‘একদিন কংগ্রেসের সভা বসেছিল কুমিল্লার টাউন হলে। বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, বাবু অতীন্দ্রমোহন রায় প্রমুখ বক্তারা বারবার তাগিদ দিয়ে নজরুলকে নিয়ে আসেন কান্দিরপাড়ের বাসা থেকে।’ সে সভায় তিনি গেয়েছিলেন এ গানটি- ‘এস এস এস ওগো মরণ!/ ওই মরণ-ভীতু মানুষ-মেষের ভয় কর গো হরণ।’
দেখা যাচ্ছে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করে তার আন্দোলনে অংশগ্রহণের সীমানা শুধু কলকাতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা শহর পর্যন্ত ছড়িয়েছিলেন। এমনই ছিল পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তার আত্মিক যোগ। ১৯২২ সালে তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। তাকে গ্রেফতার করা হয় কুমিল্লা থেকে, ঐ বছরের ২২ নভেম্বরে। পরদিন তাকে কলকাতায় নেয়া হয় এবং প্রেসিডেন্সি জেলে রাখা হয়। এইসঙ্গে তার ‘যুগবাণী’ কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করে সরকার।
১৯২৫ সালের ২৪ এপ্রিল নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হয় কুমিল্লার প্রমীলার। নজরুলের বয়স ছিল তেইশ আর প্রমীলার ষোল। বিয়েতে ধর্মীয় ও সামাজিক সূত্রে বিরোধ হয়েছিল। সব বিরোধিতা পাশ কাটিয়ে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করেন মিসেস এম রহমান। নজরুল তাকে ‘বিষের বাঁশী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেন।
দেখা যাচ্ছে দু’জন বড় মানুষের ব্যাপ্ত জীবনের পূর্ণতা পূর্ববঙ্গকে বাদ দিয়ে হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৯ সালের আষাঢ় মাসে জোড়াসাঁকোর সেরেস্তার হিসাব দেখার দায়িত্ব পান বাবার কাছ থেকে। অগ্রহায়ণ মাসে জমিদারি পরিদর্শনের অধিকার লাভ করেন। মৃণালিনী দেবী, তার বান্ধবী, বেলা ও রথীন এবং ভাইপো বলেন্দ্রনাথকে নিয়ে শিলাইদহ আসেন। শুরু হয় তার পূর্ববঙ্গ যাত্রা⎯ অবিরাম, নিরন্তর। শারীরিক এবং মানসিক ভ্রমণের সবটুকু গভীর আনন্দ দিয়েছে তার জগৎ উপুড় করে দিয়ে। পূর্ববঙ্গ যেমন দিয়েছে, তিনি তেমন দু’হাত উপচে গ্রহণ করেছেন। নিতে কুণ্ঠিত হননি। এই নেওয়াকে আপন আলোয় রাঙিয়েছেন⎯ কবিতায়, গানে, চিত্রকর্মে, নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে এবং সর্বোপরি পত্র-সাহিত্যে।
ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে শিলাইদহ উঠে এসেছে এভাবে ‘শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর⎯ ধূ ধূ করছে ⎯ কোথাও শেষ দেখা যায় না। ..... পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোট নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতি রাতে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।’
দীর্ঘ কয়েক বছর এখানে স্থায়ীভাবে বাস করে ১৯০১ সালে তিনি সংসার গুটিয়ে শান্তিনিকেতনে যান। তারপর আসা-যাওয়া করেছেন। নদীতে বসবাস করেছেন বোটে- পতিসর-শাহজাদপুর ঘোরার সময় বিল-নদীর নৌপথে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিবরণ পত্র-সাহিত্যে পাওয়া যায়। কত নিবিড়ভাবে মানুষ ও প্রকৃতিকে দেখেছেন তা বর্ণনা করে শেষ করার নয়।
রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতো পূর্ববঙ্গে আসেন ১৯৩৭ সালে। গ্রাম ছিল প্রতিসর। ১৮৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি লিখেছিলেন: ‘এখন বেলা একটা বেজেছে। পাড়াগাঁয়ে মধ্যাহ্নের এই হাঁসের ডাক, কাপড় কাঁচার শব্দ, নৌকা-চলা জলের ছলছল ধ্বনি, দূরে গরুর পাল পার করবার হৈ হৈ রব এবং আপনার মনের ভিতরকার একটা উদাস আলস্যপূর্ণ স্বগত সংগীতস্বর, কলকাতার চৌকি-টেবিল-সমাকীর্ণ, বর্ণ-বৈচিত্র্যবিহীন নিত্যনৈমিত্তিকতার মধ্যে কল্পনাও করতে পারিনে। কলকাতাটা বড় ভদ্র এবং বড় ভারী, গবর্মেন্টের আপিসের মতো। জীবনের প্রত্যেক দিনটাই যেন একই আকারে একই ছাপ নিয়ে টাঁকশাল থেকে তকতকে হয়ে কেটে কেটে বেরিয়ে আসছে⎯ নীরস মৃত দিন, কিন্তু খুব ভদ্র এবং সমান ওজনের। এখানে আমি দলছাড়া এবং এখানকার প্রত্যেক দিন আমার নিজের দিন⎯ নিত্যনিয়মিত দম-দেওয়া কলের সঙ্গে কোনো যোগ নেই।’
এই ছিল পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কবির আত্মিক যোগ। সেবার রবীন্দ্রনাথ নাগর নদীপথে পতিসর ছাড়েন। তারপর আত্রাই স্টেশন থেকে রেলে করে কলকাতায় যান।
১৯৩৬ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে ‘Degree of Doctor of Literature’ দেয়। এছাড়া কবি পূর্ববঙ্গের সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ইত্যাদি শহরে বিভিন্ন উপলক্ষে যান। জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারকে কবি যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানে আছে: ‘ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করবার জন্যে দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ... বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনো মতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করিনে।’ এভাবে গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে ঢাকা শহর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ববঙ্গে তার ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম কখনো একটানা পূর্ববঙ্গে থাকেননি, কিন্তু ঘুরে ঘুরে এসেছেন অনবরত। কাটিয়েছেন মাসাধিক কাল। বিভিন্ন শহরে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ভারতবর্ষের এক ইঞ্চি জমিতে একজন ইংরেজ থাকলেও তা পূর্ণ স্বাধীনতা হবে না। এভাবে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন দেশের মানুষকে।
কিশোর বেলায় ময়মনসিংহের দরিরামপুরে স্কুলপর্বের পর নজরুল ১৯২০ সালে বরিশালে আসেন। সেটি ছিল দূর্গা পূজার সময়। কমরেড মুজফফর আহমদ এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। কবি বেশ কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিলেন। বরিশালকে ‘বাংলার ভেনিস’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচন করেছিলেন ঢাকা বিভাগ থেকে। স্বরাজ দলের প্রার্থী হয়েছিলেন। সে বছরে তিনি নির্বাচনী প্রচারের কাজে বরিশালে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তার স্মরণে আলেকান্দায় ‘নজরুল পাঠাগার ও ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯২১ সালে কুমিল্লায় এসেছিলেন। কুমিল্লা তার জীবনের এক বড় অধ্যায়। নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরে কুমিল্লার মেয়ে প্রমীলার সঙ্গে প্রেম হয়। এই প্রেমে হিন্দু রক্ষণশীলদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। প্রমীলার মা গিরিবালা দেবী মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় যান। সেখানে ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল তাদের বিয়ে হয়। এরপরে নজরুল কুমিল্লায় আসেননি। তবে কুমিল্লায় অবস্থান তার সৃজনশীলতায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কুমিল্লার প্রকৃতি, লালমাই পাহাড়, গোমতী নদী তার কবিতা, গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে। ‘কুমিল্লায় নজরুল’ শীর্ষক গ্রন্থে আবদুল কুদ্দুস লিখেছেন: ‘কুমিল্লা নজরুলের কাব্য কাননের লালন-ক্ষেত্র, পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত পীঠস্থান, জীবননাট্যের একটা অবিস্মরণীয় অধ্যায়।’ এভাবে কালজয়ী কবির আপন আবাস পূর্ববঙ্গ হয়।
এরপর ১৯২১ সালে চাঁদপুরে আসেন, ১৯২৪ সালে কুড়িগ্রামে। ফরিদপুরে আসেন ১৯২৫ সালের ২৫ মে। উপলক্ষ ছিল বঙ্গীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন। ২ মে ফরিদপুর টাউন লাইব্রেরি মাঠে জনসভার আয়োজন হয়েছিল। সভায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সভাপতিত্ব করেন। অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধি ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। সে সময়ে কবি জসীম উদদীনের সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা হয়। তিনি নৌকায় করে ঘুরেছেন, চরে নেমে বেড়িয়েছেন। পূর্ববঙ্গের মাটি মানুষ দেখেছেন। জনসভায় বক্তৃতা করেছেন, গান গেয়েছেন। ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ গান গেয়ে মাতিয়ে তুলেছেন ফরিদপুরবাসীকে।
এরপর তিনি আরও কয়েকবার ফরিদপুরে এসেছিলেন। ১৯৩৬ সালে আসেন জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনে অংশগ্রহণ করতে। তিনি সভাপতি ছিলেন। ১৯৩৮ সালে আবার ফরিদপুরে আসেন। ‘ফরিদপুর সংসদ’ তাকে সংর্ধনা জানায়। কবি শেষবার ফরিদপুরে আসেন ১৯৪১ সালে। রংপুরে আসেন দু’বার। একবার ১৯২৫ এবং আর একবার ১৯২৮ সালে। এই বছরে তাকে রংপুরে সংবর্ধনা দেয়া হয়। দিনাজপুরে আসেন ১৯২৬ সালে। এই একই বছরে দিনাজপুর থেকে মাদারীপুরে যান। এ সময়ে মাদারীপুর শহরে নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রাদেশিক মৎস্যজীবী সম্মেলনের অধিবেশন হয়। তিনি জেলেদের নিয়ে রচিত গান গেয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
১৯২৬ সালে প্রথম ঢাকা সফর করেন নজরুল। ২৭ জুন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে তিনি বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর জোর দেন। তার রচিত গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে তোলেন। ১৯২৭ সালে আবার আসেন। ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজের সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আবার ঢাকায় আসেন। এ সময় ড. কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান ভবনের (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) বাসায় অবস্থান করেন। ‘চল চল চল’ গানটি লেখেন। এই গান গেয়ে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এরপর ১৯৪০ সালে বেতার কেন্দ্রের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন।
পূর্ববঙ্গের আরও অনেক জায়গায় ঘুরেছেন তিনি। চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, টাঙ্গাইল, বগুড়া, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জ ইত্যাদি। এবং আরও কোনো কোনো স্থান। পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা যেমন তার প্রাণের টান ছিল, তেমনি পূর্ববঙ্গবাসী তাকে সংবর্ধনা দিয়ে জানিয়েছে বুকভরা ভালবাসা।
২.
যে পূর্ববঙ্গের কথা এই লেখায় উল্লেখ করা হলো তা আজকের বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাতি অর্জন করেছে স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। তার অবর্তমানে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে তার নামে। এই যুদ্ধের রণধ্বনি ছিল ‘জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দুই মহান কবির একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তিনি তাদের বরণ করেছেন গভীর শ্রদ্ধায়, প্রদীপ্ত চেতনায়, জ্ঞানের মাহাত্ম্যে, সাহসের বলিষ্ঠতায়, মননের শাণিত প্রভায় এবং দিব্যলোকের অনিঃশেষ যাত্রায়।
১৯৬১ সাল ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে বাঙালি রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযপন করে। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’। এক পর্যায়ে পাকিস্তান বেতার থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন: ‘দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না⎯ আমরা রবীন্দ্রনাথ পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এইদেশে গাওয়া হইবেই।’
এভাবে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির সেতুবন্ধন সম্পন্ন করেছিলেন।
বেতার কর্মকর্তা আশরাফ-উজ-জামান তার ‘দেশের বেতার ও শেখ মুজিব’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘প্রবল গণ আন্দোলনে আইয়ুব খান এবং মোনায়েম খানের অপসারণের পর প্রথম বেতারের অনুষ্ঠান প্রচার নিয়ে আলাপ হয় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। দেশের ছাত্রদল ইতোমধ্যেই তাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায় ভূষিত করেছে। দেখা হতেই তিনি প্রথম বেতার নিয়ে মন্তব্য প্রকাশ করলেন। বললেন, দেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে অনুষ্ঠান প্রচার করতে না পারলে বেতার বন্ধ করে দিন। পরে কাছে এসে হেসে বলেছিলেন, একবার রবীন্দ্রনাথের ‘‘আমার সোনার বাংলা’’ গানটি বেতার থেকে প্রচার করতে পারেন না?
সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমস্ত বেতার কর্মীদের একান্ত সহায়তায় পরদিনই বেতার থেকে প্রচারিত হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ গান এবং আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত করে বেতারের অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়।’
স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ এই গানটিকে জাতীয় সংগীত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার সময়। ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জি একই বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি আসছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে বঙ্গবন্ধু বিমানে বসে গানটি গুনগুন করে গাইছিলেন। তিনি শশাঙ্ক ব্যানার্জিকে বলেছিলেন, এই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়তে ভালবাসি। আমি তাকে ভালবাসি। সাহিত্য পাঠে আমার পুঁজি ওইটুকুই। বঙ্গবন্ধুর জন্য এটি এক ধরনের সরল সত্য।
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি যখন তিনি জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করেন, তখন শুধু সাহিত্য পাঠের প্রেরণা হিসেবে নির্বাচন করেননি। কৈশোর থেকে লাভ করা অভিজ্ঞতা এবং তার ভিত্তিতে গড়ে তোলা রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিধ্বনি পেয়েছিলেন সেই গানে। যে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি তার জীবন এবং রাজনীতির সূচনা করেছিলেন, এই গান ছিল তার রবীন্দ্র রচনার পাঠজনীত অভিজ্ঞতা। তিনি তাকে নন্দিত করেছেন। বরণ করেছেন। কৃষক-মজুরের ঘামে-শ্রমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করেছেন।
এই গানের প্রতিটি চরণে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন একাকার হয়ে আছে। রবীন্দ্রসাহিত্য না পড়েই রাজনীতির যে দর্শন তিনি কিশোর বয়স থেকে স্থির করেছিলেন, পরিণত বয়সে তার প্রতিচিত্র দেখলেন রবীন্দ্রসাহিত্যে। যখন পড়লেন ‘তোমারি ধুলোমাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন জানি’ দেখলেন ওই একটি চরণে তার শৈশব-কৈশোর আশ্চর্যভাবে উদ্ভাসিত। যখন পড়লেন ‘তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে’⎯ দেখলেন বাবার ধানের গোলা থেকে নিরণ্ণজনের মাঝে ধান বিতরণের ছবি। যখন পড়লেন ‘ও মা, তোমার রাখাল, তোমার চাষি’⎯ দেখলেন বাংলার কৃষককুলকে, যারা কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ধরে রাখে⎯ তারাই তো বাস করে পাখি-ডাকা ছায়ায় ঢাকা পল্লিবাটে। যখন পড়লেন, ‘দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মাণিক হবে’⎯ দেখলেন দেশ মায়ের পায়ের ধুলো তার সারা অঙ্গে জড়ানো। পড়লেন ‘গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে’⎯ দেখলেন গরিবের ধন ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন, সেই স্বাধীনতার ভূষণ তার গায়ে জড়ানো হয়েছে। পড়লেন, ‘আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ বলে গলার ফাঁসি’⎯ দেখলেন স্বনির্ভর অর্থনীতির যে কাঠামো তার জীবনের ধ্রুব সত্য তার জন্য মৃত্যুতে উৎসর্গিত করতে হলো জীবন।
এভাবে রাজনীতির কবি, Poet of Politics, বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতির কবিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৪১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘আজ আশা করি আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের সেই ত্রাণকর্তা, মহানায়ক।
বঙ্গবন্ধুই সেই রাষ্ট্রনায়ক যিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশে এনে তার বেঁচে থাকার বাকি দিনগুলো স্বস্তির করেছিলেন⎯ শারীরিকভাবে এবং মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই কবির গান অনুপ্রেরণার অন্তহীন উৎস ছিল।
পূর্ববঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সময় নজরুল এই ভূখণ্ডকে বারবার নমস্য মেনেছেন। ‘পূর্ববঙ্গ’ নামের কবিতায় এবং ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক গানে আবেগের মাত্রা প্রকাশ পায়। অসুস্থ হওয়ার কয়েক মাস আগে দৈনিক ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ‘আমার সুন্দর’ নামে সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন ⎯ ‘আট বৎসর ধরে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলায়, প্রতি মহকুমায়, ছোট বড় গ্রামে ভ্রমণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে, কখনো কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালাম। এই প্রথম আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালবাসলাম। মনে হলো, এই আমার মা।’
১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছোটবেলা থেকে শুধু এক মন্ত্র শেখাও⎯ এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির⎯ আমাদের। ... বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক!’
পাকিস্তান সরকার নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য তার সাহিত্যে হাত দিতেও দ্বিধা করেনি। তার কবিতার ‘মহাশ্মশান’ শব্দটি বদলে দিয়ে ‘গোরস্থান’ শব্দ প্রতিস্থাপন করে।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে এম আর আখতার মুকুল তার ‘মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুল’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বঙ্গবন্ধু স্বয়ং উদ্যোগ গ্রহণ করায় মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দান করা ছাড়াও কবির রচিত ঐতিহাসিক গান ‘‘চল্ চল্ চল্, উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’’ গানটিকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ‘‘মার্চিং সংগীত’’ হিসেবে মর্যাদা দান করা হলো। এখানে শেষ নয়। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের আরো সিদ্ধান্ত হচ্ছে, অবহেলিত কবিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও শুশ্রুষার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসতে হবে। এখন থেকে সমস্ত দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে অনতিবিলম্বে ঢাকায় পাঠাবার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানানো হলো। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ মর্মে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে, বিদ্রোহী কবির উপস্থিতিতেই ঢাকায় আড়ম্বরের সঙ্গে কবির ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে। মাঝে মাত্র দিন দুয়েকের সময়। তখন নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. এ. আর. মল্লিক। তিনি তড়িৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং-এর সঙ্গে সাক্ষাত করে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার কথা অবহিত করলেন। এতেই কাজ হলো। ভারত সরকার এ ব্যাপারে সমস্ত সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান ছাড়াও রাজ্য সরকারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠিয়ে দিলো।
প্রসঙ্গত এ কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, বিদ্রোহী কবিকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ও পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়ের অবদান অনস্বীকার্য।
অবশেষে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ বিমানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। সঙ্গে এলেন সস্ত্রীক দুই পুত্র সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ এবং কবির দুই নাতনি খিলখিল কাজী ও মিষ্টি কাজী। সেদিন তেজগাঁও বিমান বন্দরে এক বিশাল জনতা বাংলাদেশের জাতীয় কবিকে সংবর্ধনা জানালো। সেদিন ঢাকা উৎসব মুখরিত। কবিকে সোজা নিয়ে আসা হলো ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ২৮ নম্বর সড়কের (পুরাতন) ৩৩০-বি বাড়িতে।’
১৯৭৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিল বাংলা একাডেমি। এই সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৪ ফেব্রুয়ার থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ১৯ তারিখ ছিল কবিতা বিষয়ক আলোচনা। ঐ দিন কবি নজরুলকে মঞ্চে আনা হয়েছিল প্রধান অতিথি হিসেবে। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘Degree of Doctor of Literature’ প্রদান করে।
১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই কবির শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কবিকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনেই তিনি ছিলেন এক বছরেরও বেশি সময়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন আগস্ট মাসের ৬ তারিখে। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও শহীদ হন ১৫ আগস্ট। রাজনীতির কবি নিজের প্রগাঢ় অনুভবের মগ্নতায় কাছে টেনেছিলেন সংস্কৃতির দুই কবিকে। বিভিন্ন বছরের একই মাসে তাদের মৃত্যু একটি স্বাধীন দেশ ও তার মানুষের কাছে বেঁচে থাকার সত্য। জাতির মননের কাছে তিনজনই ধ্রুবতারা।
একজন রাজনীতির কবি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনিবার্য করেছিলেন। বাংলা ভাষার দুই অমর কবিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে শ্রেষ্ঠ আসন দিয়েছেন।
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক