এমনভাবেই তো ফিরে আসতে হয়!
পাকিস্তান আন্দোলন তখন শেষ পর্যায়ে। সক্রিয় ছাত্র কর্মী তিনি। এর মধ্যেই বিহার অঞ্চলে দাঙ্গা কবলিত এলাকায় ত্রাণ কাজ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। একটানা দুই মাস কাজ করেছেন। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। অসুস্থতা কাটতে না কাটতেই বসতে হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ পরীক্ষায়। পাস করেন কৃতিত্বের সঙ্গে।
পাকিস্তান হওয়ার পর ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন আইন বিভাগে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ক্লাস, পড়াশোনা আর ছাত্র আন্দোলন সমানে চলছিল। ছাত্রলীগকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, সামনে জোর লড়াই আছে। মুসলিম লীগের মন্ত্রীদের পকেট ছাত্র সংগঠন দিয়ে চলবে না। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভোগী কর্মীরা বেতনসহ কিছু সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। সেটা ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। ছাত্রলীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত ছাত্রফেডারেশন এ আন্দোলন সমর্থন দিয়েছে। কর্মচারীদের সমর্থনে ছাত্র ধর্মঘট চলছে। ক্ষুব্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানসহ ২৭ ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কাউকে সরাসরি বহিষ্কার, কাউকে জরিমানা। শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনকে ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয়। বলা হয়, ১৭ এপ্রিলের মধ্যে সদাচরণের মুচলেকা দিলে ক্ষমা করা হতে পারে। বেশিরভাগ ছাত্রনেতা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে মুচলেকা দেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান মুচলেকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাকে ১৯ এপ্রিল গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই নিয়ে দ্বিতীয় বার তার জেলজীবন। প্রথম বার জেলে গিয়েছিলেন এক বছর আগে, ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ডাকা হরতালে পিকেটিং করার সময়।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের জন্ম’ গ্রন্থের লেখক কাজী আহমেদ কামাল কলকাতায় পড়াশোনার সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেকার হোস্টেলে ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন, যাবার আগে তিনি বলে যান, ছাত্র হিসেবে না হলেও আমি আবার ফিরে আসব।’
সমঝোতা প্রস্তাব নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে তার কাছে হাজির হন চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন করার সময় যার সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। ‘'সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে, ফজলুল কাদের চৌধুরী ৯ মে (১৯৪৯) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ছাত্র ও মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময়ে শেখ মুজিবকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপসের প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। ক্ষমা চাইতেও রাজি হননি। তার মতে, ছাত্ররা এমন কোনো অন্যায় করেনি যে জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। তারপরও ফজলুল কাদের চৌধুরী আপসের জন্য পীড়াপীড়ি করলে শেখ মুজিব চারটি শর্ত উপস্থাপন করেন। সকল ছাত্রছাত্রীর শাস্তি প্রত্যাহার, এ ঘটনায় আটক সকল ছাত্রের মুক্তি, নতুন করে কারো বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া ও সংবাদপত্রে খবর প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করায় তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে। আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু জীবনের যে পাঠ তিনি গ্রহণ করেছেন মাতৃভূমির প্রতি, জনগণের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ও কর্তব্যবোধ থেকে, সেটাই তাকে সংকল্পবদ্ধ করে তোলে। তিনি শপথে অটল থাকেন। আবার ফিরে আসার সেই সংকল্পের বাস্তবায়ন হয়।
কারাগার থেকে তিনি মুক্ত হন ১৯৪৯ সালের ২৬ জুন। এর তিন দিন আগে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। যেখানে গণতন্ত্র, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা, পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক স্বার্থ ও স্বায়ত্তশাসন গুরুত্বপূর্ণ। সামনে আসে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনের ধারণা। জেলে থেকেও বঙ্গবন্ধু যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার কারামুক্তির দিনে নাজিমুদ্দিন রোডের জেল গেটে ব্যান্ড পার্টিসহ বড় মিছিল নিয়ে হাজির হন দলের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কারামুক্ত তরুণ নেতাকে মিছিল করে নেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যে প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল তখনই বলতে শুরু করেন, আওয়ামী লীগ তার প্রাণপুরুষকে বরণ করে নিয়েছে।
ছাত্রত্ব নেই, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যায় তার কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে। ১৯৪৯ সালের শেষ দিনে তিনি ফের গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রফিক-সালাম-বরকতের রক্তদানে যে অমর গাথা রচিত হয়, তখনও তিনি কারাগারে। এ মহান আন্দোলন গড়ে তোলায় তিনি অবদান রেখেছেন। সে সময়ের গোয়েন্দা রিপোর্টের বারবার উল্লেখ করা হয়েছে - শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হলেও, এ সুযোগের ‘অপব্যবহার’ করে তিনি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে একের পর এক গোপন বৈঠক করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় রেখে তার সিদ্ধান্ত - আমরণ অনশন শুরু করব। যেই কথা সেই কাজ। একটানা অনশন চলে মুক্তির আদেশ না আসা পর্যন্ত–১৭ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি। আর মুক্তিলাভের ঠিক দুই মাস পর ২৬ এপ্রিল তার ওপর অর্পিত হয় ক্রমে জনপ্রিয় হতে থাকা আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। গোয়েন্দা প্রতিবেদন সূত্রে আমরা জানতে পারি, প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারি পালন উপলক্ষে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে মিছিল বের হয়, তাতে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান ও আতাউর রহমান খান।
এভাবেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ষাটের দশকের শুরুতে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রবল ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার পরিকল্পনায় ছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে আন্দোলনের কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে পরামর্শ দিতে থাকেন। আন্দোলন চলাকালেই ১৯৬২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেফতার করে চার মাস আটক রাখা হয়। বাষট্টির এ আন্দোলনের মতোই শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে ১৯৬৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি কিন্তু আমতলায় বক্তৃতা দিতে আসেননি। কিন্তু প্রেরণা কে সেটা আমজনতা জানে, তারচেয়েও বেশি করে জানে বাঙালির স্বার্থহানিতে সদা সক্রিয় পাকিস্তানের শাসক চক্র। সঙ্গত কারণেই তার স্থান হয় কারাগারে।
বাঙালির স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে উপস্থাপন করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি। এ আন্দোলন নস্যাতের জন্য দায়ের করা হয় কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গর্জে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ১১ দফা দাবিতে প্রবল ছাত্র আন্দোলন। গোটা দেশের ছাত্র-জনতা সোচ্চার হয় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে। ছিন্ন হয়ে যায় ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভের পরদিন রেসকোর্স ময়দানে ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমদের প্রস্তাবে তাকে বরণ করে নেওয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে।
এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি অনন্য উচ্চতায় ফিরে আসেন ১৯৭১ সালের ২ মার্চ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। কলাভবন সংলগ্ন বটতলায় ডাকসু ও ছাত্রলীগের আহ্বানে ছাত্র-জনতার ঢল। সেখানে উত্তোলন করা হয় লাল-সবুজ-সোনালি রঙের পতাকা, যা বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রিতিনিধিদের দ্বারা স্বীকৃত হয় জাতীয় পতাকা হিসেবে। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি যে গানটি আমাদের জাতীয় সংগীত, তারও আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এসেছিল ডাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশে তাকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেওয়া হয়। ১৯৪৯ সালে এ প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে বহিষ্কার করে যে অন্যায় আদেশ জারি হয়েছিল, তার অনুলিপি এ দিন তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে এ বহিষ্কারাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হয় আরও অনেক পরে, ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট। একটি গুরুতর ভুল ও অন্যায় এভাবে সংশোধন করা হয়।
১৯৭২ সালের ২০ জুলাই বঙ্গবন্ধুকে আরেকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হয় ছাত্র আন্দোলনের একটি বড় বিচ্যুতি সংশোধনে। কিছু ছাত্র পরীক্ষা না দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়ার অন্যায় দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করলে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার বৈঠক স্থগিত রেখে রেজিস্ট্রার ভবনে এসে উপাচার্যকে মুক্ত করেন এবং আত্মঘাতী দাবি উত্থাপনকারীদের ভৎর্সনা করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর হিসেবে এ দিন তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসার কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার দায়িত্ব বিস্মৃত হয়নি। এ প্রতিষ্ঠান থেকেই জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়, দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এবং এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে। ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর বটতলা থেকে ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ ব্যানার নিয়ে শোক মিছিল যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে। বিকেলে সিনেট সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় শোক ও ঘাতকদের বিচার দাবি করে সর্বসম্মত প্রস্তুাব গ্রহণ করা হয়, সিনেটের তিন ছাত্র প্রতিনিধি ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান এবং ছাত্রনেতা ইসমত কাদির গামা ও অজয় দাশগুপ্তের উদ্যোগে। পরদিন পালিত হয় হরতাল।
১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে আয়োজন করা হয় মিলাদ। নিষ্ঠুর সামরিক শাসনের বাধা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে দিনভর ছাত্রছাত্রীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
এভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার বার ফিরে আসেন তার প্রাণের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সগৌরবে।
অজয় দাশগুপ্ত: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক