বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য নিয়ে জামায়াতি গালগল্প

  • অমি রহমান পিয়াল   
  • ৩ অক্টোবর, ২০২০ ১১:৫৬

এসব গালগল্প প্রজন্মান্তরে চলতেই থাকে। জাস্ট টু আন্ডারমাইন শেখ মুজিব। তার মহৎ হৃদয়কে অপমান করতে এসব বানানো হয়।

গল্পটা বলেছিলেন মতিভাই, প্রথম আলোর সম্পাদক। পাকিস্তান কারাগার থেকে দেশে ফেরার পর একটা চিঠি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। লিখেছেন খান এ সবুর খান। 

পাকিস্তানিদের দালাল হিসেবে জেলবন্দী এই মুসলিম লীগ নেতা নাকি লিখেছিলেন- ‘মুজিব তুমি আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী, আর আমি কারাগারে- এ কেমন বিচার!'

চিঠিটা পড়ে নাকি আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর গাড়ি নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন কারাগারে, বের করে নিয়ে এসেছিলেন সবুর খানকে!

দ্বিতীয় গল্পটা আরও চমকপ্রদ। অন্যমুখে শোনা। 

কুমিল্লা সার্কিট হাউজে গিয়েছিলেন শেখ মুজিব। সেখানে তার সামনে খিচুড়ি দেওয়া হয়। খিচুড়ি দেখে নাকি আবেগে কেঁদে ফেলেন শেখ মুজিব। তার নাকি মনে পড়ে যায় তাকে জীবনের সেরা খিচুড়ি রেধে খাইয়েছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। 

মুজিব নাকি হুকুম দেন কুমিল্লা জেল থেকে শাহ আজিজকে মুক্ত করে নিয়ে আসতে। তার সঙ্গে বসে একসঙ্গে খিচুড়ি খাবেন তিনি। দালালির জন্য শাহ আজিজও তখন কারাগারে!

তো এসব গালগল্প প্রজন্মান্তরে চলতেই থাকে। জাস্ট টু আন্ডারমাইন শেখ মুজিব। তার মহৎ হৃদয়কে অপমান করতে এসব বানানো হয়। 

কিছুদিন আগে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন একই ধরনের কথা। সবুর খান এবং শাহ আজিজকে নিয়ে। যদিও আমি নিশ্চিত এই লেখা তার পড়ার সময় এবং ধৈর্য কোনোটাই হবে না, তারপরও টু স্ট্রেইটেন আপ দ্য রেকর্ডস, যে এসব নিতান্তই গালগল্প ছিল কিছু দলিলপত্র সহযোগে এর নিষ্পত্তি ঘটানো জরুরি মানছি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতায় এগিয়ে ছিল জামায়াতে ইসলামী। সে তুলনায় একটু নিরীহই ছিল মুসলিম লীগাররা। তাদের অপাংক্তেয় নেতারা সেই একাত্তরে একটু রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়ে বর্তে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর এদের সবারই ঠাঁই হয়েছিল কারাগারে। দালাল আইনে বন্দি ছিলেন সবাই। সবুর খান এবং পিডিপি নেতা শাহ আজিজও এদের মধ্যে ছিলেন। 

১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন। হত্যা, খুন ধর্ষণ অগ্নিকাণ্ড ও লুটপাটে জড়িত ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করেন তিনি রাষ্ট্রীয় তরফে। এই ফরমানেই জেল থেকে ছাড়া পান দালাল রাজনীতিকরা। দলিল বলছে তার আগে কেউই নয়।

৩ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের খবরে সাধারণ ক্ষমার ফলোআপ এসেছিল, যে সিদ্ধান্তকে সকল মহল স্বাগত জানিয়েছে। সেখানেই রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল সেখানে দালাল আইনে আটকদের এবং মুক্তি পাওয়াদের বিষয়ে সাংবাদিকদের ক্ল্যারিফাই করেছেন। 

‘দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের মোট সংখ্যা ৩৭ হাজার ৪ শত ৭১’ শিরোনামে ওই খবরে লেখা হয়েছে- ‘সরকার কর্তৃক সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই আদেশের আওতাভুক্ত সকল ব্যক্তির মুক্তি ত্বরান্বিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়াছেন। গতকাল (শনিবার) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সহিত আলাপ-আলোচনাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুল মালেক উকিল এ কথা জানান। তিনি বলেন যে, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন আদেশের সহিত দালালি আইনে আটক ব্যক্তিদের তালিকা পরীক্ষা করার পর ইহার আওতাভুক্ত সকল ব্যক্তিকে মুক্তিদানের জন্য তিনি ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়াছেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান- ‘দালাল আইন অনুযায়ী মোট অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা হইতেছে ৩৭ হাজার ৪ শত ৭১ জন। ইহার মধ্যে চলতি বছর অক্টোবর মাস পর্যন্ত ২ হাজার ৮ শত ৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলার নিষ্পত্তি হইয়াছে। তন্মধ্যে ৭ শত ৫২ জনের সাজা হইয়াছে এবং বাকি ২ হাজার ৯৬ জন খালাস পাইয়াছেন। তিনি বলেন একটি সংবাদপত্রে দালাল আইনে আটক ব্যক্তিদের সংখ্যা ৮৬ হাজার বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। কিন্তু উহা সত্য নহে বরং অতিরঞ্জিত।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন- ‘আটককৃত বা সাজাপ্রাপ্ত অনেক প্রাক্তন নেতা এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় মুক্তি লাভ করিবেন। তিনি বলেন যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর ডা. এ এম মালেক ও তাহার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ শীঘ্রই মুক্তিলাভ করিবেন। অন্যদের মধ্যে যাহারা মুক্তি পাইবেন তাহাদের মধ্যে ড. কাজী দীন মোহাম্মদ, ড. হাসান জামান, ড. সাজ্জাদ হোসেন, ড. মোহর আলী (প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দালাল শিক্ষক) ও খান আবদুর সবুরও রহিয়াছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাহাদের সম্পত্তি ফেরত পাইবেন এবং দেশের নাগরিকদিগকে প্রদত্ত সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করিবেন।’

পাকিস্তান থেকে ফিরেই খান এ সবুরকে বঙ্গবন্ধু নিজে গাড়ি চালিয়ে জেল থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন বলে যে গল্পটা শুনেছিলাম সেটার নিষ্পত্তি হলো এই খবরে।

দৈনিক বাংলার সেদিনের পাতাতেই আরেকটি চমকপ্রদ সংবাদ রয়েছে। জিয়া সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী হওয়া শাহ আজিজুর রহমান এবং স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত শর্ষীনার পীর সাহেবের জেলমুক্তি নিয়ে খবরটি। 

লেখা হয়- ‘বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ আদেশে গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে অধুনালুপ্ত পিডিপির নেতা শাহ আজিজুর রহমান এবং শর্ষীনার পীর সাহেবকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দখলদার বাহিনীর সাথে সহযোগিতার অপরাধে তাদের আটক করা হয়েছিল। এনার খবরে একথা জানা গেছে।’

স্মর্তব্য শাহ আজিজুর রহমান পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর সমর্থনে জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। একটু খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে গভর্নর মালেক ও শাহ আজিজের মতো হাইপ্রোফাইল দালালদের কাউকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে স্থানান্তর করা হয়নি। গ্রেপ্তারের পর থেকে তারা সেখানেই ছিলেন মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত। তাই জেল থেকে ডেকে এনে শাহ আজিজকে নিয়ে কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধুর খিচুড়ি খাওয়ার গল্পের মতো আজগুবি দাস্তান বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।

সবুর খান কিংবা শাহ আজিজ কেউ বঙ্গবন্ধুর বন্ধুগোত্রীয় নন। সমসাময়িক কিন্তু সিনিয়র এসব রাজনীতিবিদ জনপ্রিয়তার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর নখের কাছেও ছিলেন না। তাই তাদের গলায় জড়িয়ে আবেগে কেঁদে ফেলার প্রশ্নই আসে না। প্রশ্ন আসে না তাদের জেল থেকে বের করে এনে বুকে জড়িয়ে ধরার কিংবা অন্যভাবে ট্রিট করার। 

বেঈমানদের কখনও প্রশ্রয় দেননি বঙ্গবন্ধু। বরং সুযোগ দিয়েছিলেন অনুতপ্ত হওয়ার। ১৫ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত ভাষণে স্পষ্ট উচ্চারণ করেছিলেন- 

‘... বিপ্লবের পর স্বাধীনতার শত্রু হিসেবে যারা অভিযুক্ত হয়েছিল তাদেরও আমরা হত্যা করিনি, ক্ষমা করেছি... আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যারা দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছিলেন তাদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে। দেশের নাগরিক হিসাবে স্বাভাবিক জীবন যাপনে আবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি অন্যের প্রচারণায় যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং হিংসার পথ গ্রহণ করেছেন তারা অনুতপ্ত হলে তাদেরও দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে।’

এবার আসা যাক সবুর খান শাহ আজিজদের সেই সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা চালিয়ে যাওয়ার আখ্যানে। ১৯৭৪ সালের ১০ মে’র ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের এক তারবার্তায় সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পাওয়া তিনজন মুসলিম লীগ নেতাকে আবারও গ্রেপ্তার করার কথা বলে হয়েছে ‘বাংলাদেশ বিরোধী চক্রান্তের অভিযোগে' এরা হচ্ছে খান এ সবুর, খাজা খয়েরউদ্দিন ও শফিকুর রহমান (শান্তি কমিটির সঙ্গে জড়িত)। 

২৬ আগস্ট তাদের গ্রেপ্তারের কারণ হিসেবে বলা হয়, এরা সমর্থকদের নিয়ে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে আবারও সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, পাকিস্তানীদের সহযোগী নিহত রাজাকার-আলবদরদের ক্ষতিপূরণের জন্য প্রকাশ্যে দাবি জানাচ্ছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধে বন্দী দালালদের মুক্তি দাবি করছিল। 

পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী কার্যক্রমের যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে (এরা পলাতক, দেশের বাইরে থেকে দেশের সার্বভৌমতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, যেমন গোলাম আযম) তা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা দাবি তুলেছিল। কিছুদিন পর একই অভিযোগে আবারও গ্রেপ্তার হন শাহ আজিজ। 

১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর তাদের মুক্ত এবং পুনর্বাসিত করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং জিয়াউর রহমান। এটাই ইতিহাস, বাকিটা রূপকথা...।

 

অমি রহমান পিয়াল: সাংবাদিক, ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

এ বিভাগের আরো খবর