অমর একুশে বইমেলায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বই পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে স্পর্শ ফাউন্ডেশনের ‘স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা’। বলা যায়, প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়মে আটকে পড়া দৃষ্টিবঞ্চিতদের তারা আলো বিতরণ করছে।
দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্পর্শ ব্রেইলের স্টলে এসে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বই পড়ছেন। আর দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বই পড়ার সেই দৃশ্য সবার নজর কাড়ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কেউ বই দেখছেন, কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়া শুনছেন। আবার কেউ কৌতূহলী মন নিয়ে ব্রেইল পদ্ধতি সম্পর্ক জানতে চাইছেন। সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন স্পৰ্শ ব্রেইল প্রকাশনীর স্টলের সহযোগীরা।
বইমেলার স্টলে দৃষ্টিহীন মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। ছবি: নিউজবাংলা
স্পর্শ ব্রেইলের স্বেচ্ছাসেবক রবিউল হাসানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বই বিক্রি নয়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা যে পড়তে পারে সে তথ্য জানাতেই মেলায় স্টল নিয়েছে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনী। ২৪ ফেব্রুয়ারি তারা ১৯টি ব্রেইল বই প্রকাশ করেছে। আর ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তারা বই প্রকাশ করেছে ১৫০টি।
ব্রেইল বই লেখা আর পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে স্টলের এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ‘ব্রেইল বই পড়ার জন্য ছয় ডটের একটি কোড নম্বর থাকে। বাংলার প্রতিটি বর্ণ এই ছয় ডট দিয়ে লেখা। ব্রেইল বই পড়তে হলে তাদের এই ছয় ডটের কোড শিখতে হয়। এরপর তারা পৃষ্ঠায় থাকা ছাপ হাত দিয়ে স্পর্শ করে বুঝতে পারে কোন বর্ণ দিয়ে কী শব্দ লেখা হয়েছে।’
ব্রেইল বই তৈরির খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবক রবিউল হাসান বলেন, ‘ব্রেইল বই করার আলাদা পদ্ধতি আছে। এগুলো একটু ব্যয়বহুল। ব্রেইল বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা কিনতে ৭ থেকে ৯ টাকা পড়ে যায়। আর আছে প্রিন্টিং-মুদ্রণ ব্যয়।’
তিনি বলেন, সাধারণ বইয়ের এক পৃষ্ঠার সমান আমাদের ব্রেইল বইয়ের ৩-৪ পৃষ্ঠা। একটি বইয়ের খরচ নির্ভর করে কত পৃষ্ঠার বই হচ্ছে তার ওপর। বইগুলো দেশেই তৈরি করা হয়। আমাদের ব্রেইল পেইজ আছে। যেকোনো বই দিলে আমরা করে দিতে পারি।’
বই তৈরির খরচ নির্বাহ কীভাবে করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আছেন। তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় আমরা এসব বই প্রকাশ করি।’
কপিরাইট পাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা তৈরি হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কপিরাইট নিয়ে আমাদের এখনও কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। যেহেতু আমরা বিনামূল্যে বই বিতরণ করি, কোন লাভজনক প্রতিষ্ঠান না, তাই কপিরাইট পেতে আমাদের সমস্যা হয় না। লেখকদের বললে তারা দিয়ে দেন।’
রবিউল বলেন, ‘এ বছর আমরা যেসব ব্রেইল বই প্রকাশ করেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’। এছাড়া প্রসিদ্ধ বইয়ের মধ্যে গত বছর আমরা করেছি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ বইটি। ‘চাঁদের পাহাড়’, হুমায়ূন আহমেদের কিছু প্রসিদ্ধ বইয়েরও ব্রেইল বই প্রকাশ করেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি এগিয়ে আসুক। তারা ঘোষণা দিয়ে সব প্রকাশনীর জন্য বাধ্যতামূলক করুক যে, বইমেলায় স্টল দিতে হলে প্রতিটি প্রকাশনীর একটি করে ব্রেইল বই প্রকাশ করতে হবে। তাহলেই প্রতিবছর আমরা পাঁচ থেকে ছয় হাজার বই পেয়ে যাব।
‘আমাদের লক্ষ্য আছে ব্রেইল বইয়ের লাইব্রেরি করার। করপোরেট মালিকরা এগিয়ে এলে আমাদের জন্য কাজটা সহজ হয়। আমাদের এই ব্রেইল স্টলে বেতনভুক্ত কেউ কাজ করে না। সবাই আমরা ফ্রিতে কাজ করি।’
রবিউল আরও বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা আমাদের স্টলে এসে বই পড়তে পারে। আর প্রতিবছর আমাদের প্রকাশনা উৎসব হয়। এজন্য মাস জুড়ে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চলে। যারা রেজিস্ট্রেশন করে তাদের মাঝে আমরা এদিন ফ্রিতে বই বিতরণ করি। এবার প্রায় নব্বইজন রেজিস্ট্রেশন করেছেন। প্রত্যেককে আমরা চার থেকে পাঁচটি বই ফ্রিতে দিয়ে দিয়েছি।’
কেন এই উদ্যোগ জানতে চাইলে অন্য এক স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ‘দৃষ্টিহীনদের মাঝে সাহিত্যের রস পৌঁছানোই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। বইমেলায় শুধু আমাদের এই প্রকাশনীতেই দৃষ্টিহীনদের ব্রেইল বই পাওয়া যায়। আমরা চাই, যারা দৃষ্টিহীন তারাও যেন সাহিত্যের রস থেকে বঞ্চিত না হন।
‘তাদেরও তো ইচ্ছে থাকে যে তারা বিভিন্ন লেখকের গল্প-উপন্যাস পড়বেন। তারা জাফর ইকবাল স্যার, হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে পড়তে চান। কিন্তু এসব বই তো আর ব্রেইলে পাওয়া যায় না। বইমেলার প্রতিটি স্টলে যেন ব্রেইল বই থাকে সেটাই আমাদের সামাজিক আন্দোলনের লক্ষ্য।’
স্টলে এসে ব্রেইল বই পড়ছিলেন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর দৃষ্টিজয়ী শিক্ষার্থী মহিনি আক্তার তামিম। তিনি বলেন, ‘এই ব্রেইল পদ্ধতি শিখতে আমার এক মাস সময় লেগেছে। ছয় বছর বয়সে আমি প্রথম স্কুলে ভর্তি হই। তখনই আমার ব্রেইল পদ্ধতি শেখা।’
তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এসে আমার পছন্দের অনেক বই পড়ে শেষ করেছি। একমাত্র স্পর্শই আমাদের জন্য ব্রেইল বই সরবরাহ করে। তাই আমরা স্পর্শের কাছে কৃতজ্ঞ।’
ছাত্রলীগের উদ্যোগে বুধবার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বইমেলা ঘুরিয়ে দেখানো হয়। ছবি: নিউজবাংলা
দৃষ্টিহীন মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মেলা ঘুরে দেখাল ছাত্রলীগ
এদিকে মদীনাতুল উলূম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মাদরাসার ৫০ জন শিক্ষার্থীকে বই মেলা ঘুরে দেখিয়েছেন ছাত্রলীগের মাদরাসা বিষয়ক সম্পাদক জহিরুল ইসলাম। এদের মধ্যে ২১ জন দৃষ্টিহীন।
কেন এই উদ্যোগ জানতে চাইলে জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগে কয়েকবার আমি এই মাদরাসায় গিয়েছি। সেখানে দেখেছি তারা সবসময় কোরআন শরীফ পড়েন। ফ্রি সময়ে অন্য কোনো বই পড়ার সুযোগ তারা পান না। তখন আমি চিন্তা করেছি যে বই না পড়ার কারণে তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবেন না। তাই আমি ঠিক করেছি তাদের বইমেলা ঘুরে দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ওপর থাকা ব্রেইল বইগুলো উপহার হিসেবে দেবো। সেজন্য আজকে আমি তাদেরকে মেলা ঘুরিয়ে দেখিয়েছি। আর বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, একাত্তরের ডায়েরি, আমার বন্ধু রাসেদসহ অনেক গল্প ও কবিতার বই যেগুলোর ব্রেইল ভার্সন রয়েছে সেসব উপহার দিয়েছি।’
২৮তম দিনে ৮০ নতুন বই
বুধবার অমর একুশে বইমেলার ২৮তম দিনে নতুন বই এসেছে ৮০টি। এদিন মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত।
অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ মুনীর চৌধুরী এবং স্মরণ হুমায়ুন আজাদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে অধ্যাপক ফিরোজা ইয়াসমীন ও অধ্যাপক হাকিম আরিফ।
আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম, অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক, ওসমান গনি ও মৌলি আজাদ। সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কাজী জাহিদুল হক সংকলিত এবং ঐতিহ্য প্রকাশিত মুনীর চৌধুরীর দুষ্প্রাপ্য রচনা বই-উন্মোচনে অংশ নেন অনুষ্ঠানের সভাপতি ফেরদৌসী মজুমদার, প্রাবন্ধিকদ্বয়, আলোচকবৃন্দ, বিশিষ্ট নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার এবং গ্রন্থটির সম্পাদক কাজী জাহিদুল হক।
আলোচকবৃন্দ বলেন, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মুনীর চৌধুরী শোষিত ও মুক্তিকামী মানুষদের জন্য সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। আমাদের সামনে তিনি বিপ্লবী জীবনের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
সভাপতির বক্তব্যে ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি মুনীর চৌধুরী ও হুমায়ুন আজাদের ভালোবাসা ছিল সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত। তাদের জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে।’
‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান, কবি তারিক সুজাত, কথাসাহিত্যিক সমীর আহমেদ ও শিশুসাহিত্যিক আবেদীন জনি।
বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চে বিকেল ৫টায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘সংস্কৃতি ও সদাচার’ বই নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. মো. হাসান কবীর এবং সম্পাদকীয় পর্ষদের সদস্যবৃন্দ।
বৃহস্পতিবারের কর্মসূচি
বৃহস্পতিবার অমর একুশে বইমেলার ২৯তম দিন। এদিন বিকেল ৩টায় মেলা শুরু হয়ে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।