বরাবরের নিয়ম মেনে ২৯ তারিখ অমর একুশে বইমেলা শেষ হলে এটা ছিল মেলার শেষ শুক্রবার। আর সাপ্তাহিক ছুটির এই দিনে এসে মেলা যেন পূর্ণতা পেয়েছে। জমে উঠেছে প্রাণের বইমেলা।
মেলায় অংশ নেয়া বিভিন্ন প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলছেন, অন্য শুক্রবারের চেয়ে এদিন তুলনামূলক ভিড় একটু বেশি ছিল। বিক্রিও হয়েছে ভালো। তবে মেলা আরও দুদিন বাড়ানোর জন্য প্রকাশকদের যে দাবি সেটি বাস্তবায়িত হলে আরও একটি শুক্রবার পাবে বইমেলা। যদিও আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কিছু জানায়নি।
শুক্রবার বইমেলায় ঢুকতে হয়েছে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে। ছবি: নিউজবাংলা
সরেজমিনে দেখা যায়, শুক্রবার প্রবেশপথে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পাঠকদের ঢুকতে হচ্ছে বইমেলায়। মেলার ভেতরের প্রাঙ্গণও দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর। শুক্রবার হওয়ায় অনেকে শিশু সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মেলায় এসেছেন।
বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টলের সামনে ছিলো সব বয়সী পাঠকের ভিড়। কেউ বই দেখছেন, কেউ কিনছেন। আবার কেউ তুলছেন ছবি।
প্রকাশকরা বলছেন, বই না কিনুক, ছবি তোলার জন্য হলেও সবাই যে বইমেলামুখী হচ্ছে এটাই খুশির খবর।
ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি সোলাইমান বলেন, ‘আজকে শিশু প্রহরের সময় সকালে একটু বিক্রি কম ছিলো। তবে দুপুরের পর থেকে ভালোই বিক্রি হচ্ছে।’
আগামী প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি রবিউল ইসলামও বললেন একই কথা।
মাওলা ব্রাদার্সের বিক্রয় প্রতিনিধি রমিম বলেন, ‘আজ যে মেলার শেষ শুক্রবার তা ভিড় দেখে বোঝা যাচ্ছে। অন্যান্য দিনের তুলনা ভালো বিক্রি হচ্ছে। তবে শুক্রবার হিসেবে ভিড় বেশি হলেও বইয়ের ক্রেতা ততোটা নেই।’
মিরপুর থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মেলায় এসেছেন কবির আহমেদ। বললেন, ‘বউ কয়েক দিন ধরে বলছিল মেলায় যাবে। কিন্তু অফিসের ব্যস্ততার কারণে আাসা হয়নি। আজ আবার মেলার শেষ শুক্রবার। আজ না এলে এবার আর আসাই হবে না। তাই ওদের আবদার মেটাতে চলে এসেছি। ভালোই লাগছে।’
এদিকে প্রতিটি ছুটির দিনের মতোই শুক্রবারের শিশুপ্রহর মাতিয়ে রেখেছে সিসিমপুরের হালুম ইকু আর টুকটুকিরা। তাদের সরাসরি দেখে আনন্দের সীমা ছিলো না ছোট্ট সোনামনিদের। তাদের আনন্দ হাসি ফুটিয়েছে সঙ্গে মা-বাবার মুখেও।
উদয়ন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাহমিদকে নিয়ে মেলায় সিসিমপুর দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মনির হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাসা একটু দূরে হওয়ায় আর বাইরে খেলার পরিবেশ না থাকায় ছেলেরা তেমন খেলতে পারে না। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়েই তাদের থাকতে হয়। শিশুদের মোবাইলের আসক্তি কাটাতে বইয়ের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো জরুরি। তাই বাচ্চাকে এখানে নিয়ে এসেছি।’
মেলা দুদিন বাড়ানোর দাবি
এদিকে মেলার শেষ দিন ২৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার হওয়ায় দুদিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন প্রকাশনীর প্রকাশকেরা। তাদের বক্তব্য, তাহলে মেলা সাপ্তাহিক ছুটির দিন দুটি পাবে।
অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘পাঠকরা বিভিন্ন পেশায় জড়িত থাকায় সরকারি ছুটির দিনগুলোতে মেলায় ওনারা আসার একটু বেশি সুযোগ পান। এবার যেহেতু বৃহস্পতিবারই মেলা শেষ হচ্ছে, তাই দুদিন বাড়িয়ে শুক্রবার আর শনিবারও যদি মেলা থাকে তাহলে পাঠকরা আসার সুযোগ পেতেন। আমাদেরও একটু বেশি ভালো বিক্রি হতো। তাই আমরা চাই মেলার সময় দুটি দিন বাড়ানো হোক।’
তবে ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টল ম্যানাজার আমজাদ হোসেন খান বলেন, ‘মনে হচ্ছে না মেলা দুদিন বাড়ানো হবে। এটি করলে মেলার ঐতিহ্য নষ্ট হবে।’
২৩তম দিনে মেলায় বই এসেছে ১৯৭টি
শুক্রবার মেলা শুরু হয় সকাল ১১টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই এসেছে ১৯৭টি।
সকাল সাড়ে ১০টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মো. হাসান কবীর।
প্রধান অতিথি ছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা
ক-শাখায় প্রথম হয়েছে ওয়াফিয়া নূর, দ্বিতীয় আর্লিন আহমেদ সানভী ও তৃতীয় হয়েছে তাইফা জান্নাত; খ-শাখায় প্রথম হয়েছে সৌভিক সাহা, দ্বিতীয় প্রত্যুষা রায় ও তৃতীয় শাফিন উদ্দিন আহাম্মেদ এবং গ-শাখায় প্রথম স্বস্তি চৌধুরী, দ্বিতীয় সপ্তনীল হাওলাদার ঐশী ও তৃতীয় হয়েছে সুয়েত আহমেদ নিহাল।
শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা
ক-শাখায় প্রথম হয়েছে ফারহিনা মোস্তাক আযওয়া, দ্বিতীয় অংকিতা সাহা রুদ্র এবং তৃতীয় ফাবলিহা মোস্তাক আরওয়া। খ-শাখায় প্রথম সমৃদ্ধি সূচনা স্বর্গ, দ্বিতীয় সুবহা আলম ও তৃতীয় অন্বেষা পণ্ডিত এবং গ-শাখায় প্রথম সিমরিন শাহীন রূপকথা, দ্বিতীয় আবদুল্লাহ আল হাসান মাহি ও তৃতীয় হয়েছে তাজকিয়া তাহরীম শাশা।
শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা
ক-শাখায় প্রথম নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির, দ্বিতীয় রোদসী আদৃতা এবং তৃতীয় নৈঋতা ভৌমিক। খ-শাখায় প্রথম তানজিম বিন তাজ প্রত্যয়, দ্বিতীয় সুরাইয়া আক্তার ও তৃতীয় রোদসী নূর সিদ্দিকী। গ-শাখায় প্রথম কে. এম. মুনিফ ফারহান দীপ্ত, দ্বিতীয় নবজিৎ সাহা ও তৃতীয় হয়েছে সরকার একান্ত ঐতিহ্য।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মামুন হুসাইন। আলোচনায় অংশ নেন ওয়াসি আহমেদ এবং জাফর আহমদ রাশেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।
প্রাবন্ধিক বলেন, ‘আমাদের কালের এক আশ্চর্য-নির্লোভ মানুষ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চেনা বাস্তবতাকে প্রসারিত করেন প্রচলিত দৃষ্টি ও বুদ্ধিগ্রাহ্যতার ওপারে। আমাদের আদিকল্প, ইন্দ্রজাল, উপকথা তিনি চিনেছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে।’
আলোচকবৃন্দ বলেন, বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিমান লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যদর্শন, সংশীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজস্ব চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জানতে হলে তার সাহিত্য পাঠ একান্ত জরুরি। তিনি ছিলেন সংবেদনশীল ও অনুসন্ধিৎসু একজন লেখক। সমাজের নানা দিকে তার সাহিত্যিক দৃষ্টি ছিল প্রসারিত। তিনি তার চিন্তাশীলতার মধ্য দিয়েই একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বোধ ছিল শাণিত, ভাষা ঝরঝরে এবং চিন্তা ছিল স্বচ্ছ। নিরন্তর নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই তার সাহিত্য অনন্য উচ্চতা লাভ করেছে। নবীন পাঠকদের আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যপাঠে উৎসাহিত করতে হবে।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন লেখক, পর্যটক ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক, কথাসাহিত্যিক নভেরা হোসেন, কবি কুশল ভৌমিক ও শিশুসাহিত্যিক আহমেদ জসিম।
বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চের আয়োজন
এই মঞ্চে বিকেলে পারস্য সাহিত্যের অনুবাদক ও লেখক অধ্যাপক শাকির সবুর রচিত সমকালীন ইরানের কবি ও কবিতা এবং ফারসি থেকে অনূদিত বুজুর্গে আলাভির তার চোখগুলো বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
শনিবারের সময়সূচি
অমর একুশে বইমেলার ২৪তম দিন শনিবার মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টায় থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলবে শিশুপ্রহর।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: মোহাম্মদ রফিক এবং খালেক বিন জয়েনউদদীন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।