প্রাণের মেলায় প্রতিদিনই আসছে নতুন অনেক বই। থরে থরে আসা সেসব অনেক বইয়ের ঘটা করে মোড়ক উন্মোচনও হচ্ছে। মৌসুমী লেখকদের বইও কম আসছে না প্রতিবছরের মতো এবারের মেলাতেও। গল্প, কবিতা, জীবনী আর উপন্যাসের বই যে হারে মেলায় প্রকাশ পাচ্ছে, সে হারে প্রকাশ পাচ্ছে না অন্য ক্যাটাগরির বই। বিশেষ করে গবেষণাধর্মী বইয়ের সংখ্যা তেমনভাবে বাড়ছে তো না-ই, বরং প্রতিবছরই এই সংখ্যা কমছে।
বিষয়টি আক্ষেপ করার মতোই। তবে এসব বইয়ের পাঠক না থাকায় প্রকাশকরাও তা প্রকাশে তেমন আগ্রহ দেখান না বলে উল্লেখ করেন।
তাদের মতে, মেলায় একটি সস্তা বিষয়ের বইয়ের যেমন কাটতি রয়েছে, তেমনিভাবে সিরিয়াস বইয়ের কোনো কাটতি থাকে না। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এসব বইয়ের পাঠকের সংখ্যা দিন দিন কমছে, যা সাহিত্যের জন্য অশনি সংকতে বলে মন্তব্য করেন বোদ্ধারা।
তাদের মতে, সচেতন পাঠক তৈরি না হলে, ভালো মানের বইও প্রকাশ পাবে না। ফলে দিন দিন সস্তা ও চটুল বই বেশি প্রকাশ পাবে। এতে করে সাহিত্যের মান নষ্ট হয়ে যাবে। তবে ভালো মানের বইয়ের পাঠক তৈরিতে প্রকাশকেরও বড় ভূমিকা রয়েছে বলে তারা অভিমত দেন।
মেলার ১৫তম দিন শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার। এই ক’দিনে বই এসেছে ১ হাজার ৩২৯টি। এর মধ্যে গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ পেয়েছে মাত্র ৩০টি। এই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। অন্য ক্যাটাগরি বইয়ের তুলনায় এই বিষয়ের বই অনেক কম বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মীরা।
কিছু নির্দিষ্ট প্রকাশনীই এই বছর গবেষণাধর্মী নতুন বই নিয়ে এসেছে। তারা বলছেন, এসব বইয়ের পাঠক নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মানুষ। আবার সবাই চিন্তাকে উস্কে দেয়ার মতো গবেষণাধর্মী বই লিখতেও পারেন না। তাই এসব বইয়ের সংখ্যা কম।
জিনিয়াস প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী মশিউর রহমান বলেন, ‘এ বছর আমাদের প্রকাশনী থেকে গবেষণাধর্মী নতুন কোনো বই আসেনি। গবেষণামূলক পুরাতন কোনো বইও তেমন নেই।’
এই বইগুলো নিয়ে পাঠকের তেমন সাড়া পাওয়া যায় না বলে জানান এ বিক্রয়কর্মী।
তবে প্রথমা প্রকাশনী গবেষণাধর্মী বই বেশি প্রকাশ করে। তাদের বইয়ের উপর পাঠকেরও চাহিদা বেশি।
প্রথমার স্টল ম্যানেজার জাকির হোসেন বলেন, “ভালো মানের মানসসম্মত বই নিয়েই আমরা বইমেলায় আসি। এ বছর আমাদের প্রকাশনী থেকে অনেকগুলো নতুন গবেষণাধর্মী বই প্রকাশিত হয়েছে। যেমন- মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপির ওপর লেখা বই ‘একাত্তরের দিনপঞ্জি’, বিরূপাক্ষ পালের ‘বাংলাদেশের অর্থ খাত ও নীতি-অনীতির দ্বন্দ্ব’, আনু মুহাম্মদ স্যারের ‘অর্থশাস্ত্র’ উল্লেখযোগ্য। এসবের চাহিদাও অনেক ভালো পাচ্ছি। মূলত গবেষণাধর্মী বইগুলো আমাদের প্রকাশনী থেকেই বেশি বিক্রি হয়।”
ইত্যাদি প্রকাশনীর প্রকাশক জহুরুল আবেদীন জুয়েল বলেন, “প্রতিবছর আমরা কিছু এই ক্যাটাগরির বই প্রকাশ করি। এ বছরও আমাদের নতুন কিছু গবেষণাধর্মী বই এসেছে। তার মধ্যে দীপংকর মোহান্তর লেখা ‘সিলেটে রবীন্দ্র-পরিক্রমা (১৯১৯-২০১৯)’ বইটিতে ভালো সাড়া পাচ্ছি।”
কথা প্রকাশের বিক্রয়কর্মী ফাহিম বলেন, “গবেষণার ওপর কিছু বই এসেছে। যেমন: সিরাজুল ইসলাম স্যারের ‘সাতচল্লিশের দেশভাগে গান্ধী ও জিন্নাহ’, হরিশংকর জলদাসের ‘বর্ণবৈষম্যের শেকড়বাকড়’, মোহাম্মদ হাননানের লেখা ‘বাঙালি মুসলমানের প্রত্যুষকাল’- এসব বইয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছি।’
অন্বেষা প্রকাশনীর সিইও ফাতিমা বুলবুল বলেন, ‘যেহেতু আমরা সব ধরনের বই প্রকাশ করি, তাই এসব বইও আমাদের রাখতে হবে। তবে অন্যান্য ক্যাটাগরির তুলনায় এসব বই একটু কম বিক্রি হচ্ছে। কারণ এসব বইয়ের পাঠক নির্দিষ্ট। ওই পাঠকরাই মেলায় এসে এসব বই খুঁজছেন এবং কিনছেন।’
মেলা ঘুরে এবারের বেশকিছু গবেষণা ধর্মী বই পাওয়া গেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ইসরাত মেরিনের ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন: দেশকাল জীবন ও সাহিত্যকর্ম, উৎস প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ড. নাজমুস সাকিবের ‘প্রতিদিন রবিন্দ্রনাথ’, এডুসেন্ট্রিক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘নজরুল ও বঙ্গবন্ধু শতবর্ষের আলোকে’, এনআরবি স্কলারস থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও জাপান সম্পর্ক’, নয়নজুলি প্রকাশনী থেকে ‘ভারতবর্ষে স্বাধীনতার কৃতিত্ব হিটলারের’, ড. মোহাম্মদ আলী খানের ‘প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসক ডা. কাদম্বিনী গাঙ্গুলী’, ঐতিহ্য থেকে ‘আমাদের নজরুল’, আবুল আহসান চৌধুরীর ‘আমার লালন’, সৈয়দ মবনুর লিখা ‘মার্কস চিন্তার সহি তাফসির’ এবং টাঙ্গন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘ড. বাবুল বিশ্বাসের নাট্যভাবনায় মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ অন্যতম।
এদিকে মেলায় গবেষণামূলক বই কম প্রকাশ হওয়া নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘মানুষের চিন্তা প্রসারিত করার মতো বই প্রকাশ বেশি হওয়া দরকার। তবে মেলায় কয়েকদিন এসে বুঝেছি, এই ধরনের বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গড়তে হলে আমাদের গবেষণাধর্মী বইয়ের উপর বেশি নজর দিতে হবে।’
আজকের বইমেলা
আজ সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে মেলায় বেশ ভালোই ভিড় দেখা গেছে। ফাগুনের দ্বিতীয় দিনে সন্ধ্যার পর থেকে পাঠকের আনাগোনা বেশ বেড়ে যায়। বই বিক্রিও ভালো হয়েছে বলে জানান প্রকাশকরা। এদিন মেলা বিকেল তিনটায় শুরু হয়ে চলে রাত নয়টা পর্যন্ত।
মেলায় নতুন বই এসেছে ৯৭টি। বিকেল চারটায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ : আবদুল হালিম বয়াতি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জোবায়ের আবদুল্লাহ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মো. নিশানে হালিম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাইদুর রহমান বয়াতি।
‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক মাসুদুল হক, কবি ও সম্পাদক এজাজ ইউসুফী এবং গবেষক কাজী সামিও শীশ এবং শিশুসাহিত্যিক রুনা তাসমিনা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, মিহির মুসাকী, শফিক সেলিম, খোকন মাহমুদ এবং ইমরুল ইউসুফ।
আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী এ বি এম রাশেদুল হাসান, শিরিন জাহান এবং তালুকদার মো. যোবায়ের আহম্মেদ টিপু। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করেন সুবর্ণা আফরিনের পরিচালনায় ‘কিংবদন্তি আবৃত্তি পরিষদ’ এবং মো. রহমতুল্লাহর পরিচালনায় ‘কথাশৈলী আবৃত্তি চক্র’। পুথিপাঠ করেন এথেন্স শাওন।
এছাড়াও ছিল প্রণয় সাহার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী বাবু সরকার, কোহিনুর আক্তার গোলাপী, মেহেরুন আশরাফ, অঞ্জলি চৌধুরী, গঞ্জের আলী জীবন, সুমন চন্দ্র দাস এবং বিজন কান্তি রায়।
আগামীকালের বইমেলা
আগামীকাল শুক্রবার মেলার ১৬তম দিন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বেশ জমজমাট বইমেলা হবে বলে প্রকাশক তথা আয়োজকরা জানান। বেচাবিক্রিও ভালো হবে বলে আশা করছেন তারা।
মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর।
সকাল ১০টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অমর একুশে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
বিকেল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ : ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।
এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন হারিসুল হক। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ফজিলাতুন নেছা মালিক এবং এস এম মোস্তফা জামান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ।