অমর একুশে বইমেলা যেন তারুণ্যের মেলা। প্রতিবছর শুরু থেকেই মেলা প্রাঙ্গণ তরুণ-তরুণীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও।
মেলায় আগতদের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। আবার বই প্রকাশের ক্ষেতেও পিছিয়ে নেই তরুণ লেখকরা। আবার মেলার বিভিন্ন প্রকাশনীতে দায়িত্বরত বিক্রয় প্রতিনিধিরাও অধিকাংশই তরুণ-তরণী।
সরেজমিনে দেখা যায়, বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের চেয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ বেশি জমজমাট। তবে দুই প্রাঙ্গণই তারুণ্যে ভরপুর। মেলা প্রাঙ্গণে ঘুমধ্যবয়সীদের দেখা মিলছে কম। বিক্রয় প্রতিনিধিরাও বলছেন, মেলায় বই দেখতে বা কিনতে তরুণ-তরুণীরাই বেশি আসছেন।
বাংলা একাডেমি প্যাভিলিয়নের বিক্রয় প্রতিনিধি শামিম আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এখানে লোকজ সংস্কৃতির বইগুলো, বঙ্গবন্ধুর অসামাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমির অভিধান এগুলো বেশি বিক্রি হয়। সাধারণত তরুণ-তরুণী এবং কিশোররাই এ বইগুলো বেশি কিনছে। তারা আসছেও বেশি সংখ্যায়। আর মেলা চত্বরে চোখ মেললেই বোঝা যায় এখানে তরুণ-তরুণীর সমাগমই বেশি।’
তাম্রলিপি প্রকাশনীর সহকারী ম্যানেজার সুমাইয়া তাবাস্সুম বলেন, ‘আমাদের প্রকাশনীতে সবেমাত্র অনার্সে উঠেছে এরকম শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বেশি। ২৫-৩০ বছর বয়সীদেরও ভালো উপস্থিতি আছে। তারা বই দেখছেন আবার কিনছেনও।’
অন্বেষা প্রকাশনীর এক বিক্রয় কর্মীও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘তরুণ বয়সের পাঠক বা ক্রেতারা মেলায় আসছেন বেশি। আর প্রবীণ যারা আছেন তারা একবার এসেই সব বই একসঙ্গে কিনে নিয়ে যান। কিন্তু তরুণ-তরুণীরা প্রায়ই আসছেন। মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরছেন, আড্ডা দিচ্ছেন।’
মিজান পাবলিশার্স প্যাভিলিয়নের ম্যানেজার সুরাইয়ার মতে, দর্শনার্থী বা ক্রেতাদের মধ্যে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা বেশি আসছেন। তারাই বই বেশি কিনছেন।
তবে কিছু প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধি বলছেন ভিন্ন কথাও। তাদের মতে, মেলায় বই দেখছেন তরুণরা বেশি; আর কিনছেন মধ্যবয়সীরা বেশি।
ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী কায়সার হোসেন মামুন বলেন, ‘আমাদের প্রকাশনীর বইগুলোর দাম একটু বেশি হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আমাদের থেকে একটু বই কম কেনে। যারা কেনেন তাদের মধ্যে চাকরিজীবী বা যারা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত তাদের সংখ্যা বেশি।’
মাওলা ব্রাদার্সের বিক্রয় প্রতিনিধি সাইফুল্লাহ বলেন, ‘যারা বই কিনছেন তাদের মধ্যে প্রবীণ বা মধ্যবয়সীরা বেশি৷ আর যারা দেখছেন বা মেলায় আসছেন তাদের মধ্যে তরুন-তরুণী বেশি।’
বই প্রকাশে পিছিয়ে নেই তরুণ লেখকরা
অন্বেষা প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক নাদিম মাহমুদ বলেন, ‘এ বছর মেলায় আমাদের প্রকাশনী থেকে ৬০টা বই বের হবে। তার মধ্যে ৩৫টিরও বেশি বইয়ের লেখক তরুণ। বই মানসম্মত হলেই আমরা বই প্রকাশ করি। তরুণ বা প্রবীণ এগুলো দেখি না।’
ঐতিহ্য প্যাভিলিয়নের ইনচার্জ আমজাদ হোসেন খান কাজল বলেন, ‘এ বছর আমরা ২৩০টি নতুন বই প্রকাশ করছি। তার মধ্যে শতাধিক বই তরুণদের।’
মিজান পাবলিশার্সের ম্যানেজার সুরাইয়া বলেন, ‘নতুন ১০০টি বই এসেছে। তার মধ্যে ত্রিশটা বই-ই তরুণ লেখকদের।’
ভিন্নমত
কথাপ্রকাশ প্যাভিলিয়নের ইনচার্জ জাফিরুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর আমাদের প্রকাশনী থেকে ৪৭টি নতুন বই প্রকাশ হয়েছে। তার মধ্যে চল্লিশ বছরের নিচের কোনো লেখকের বই নেই। আর এদের মধ্যে নতুন লেখকও কেউ নেই।’
তরুণদের বই নেই কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা সম্পাদনা পরিষদ আছে। লেখকরা তাদের বইয়ের পাণ্ডুলিপি আমাদের কাছে জমা দেন। এরপর এসব পাণ্ডুলিপি পরিষদ বিচার-বিশ্লেষণ করে। এর মধ্যে যেগুলো আমাদের পলিসির সঙ্গে যায় না বা মানসম্মত নয় সেগুলো ছাপা হয় না।’
মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশনীর আইটি সেক্টরের ম্যানেজার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘এ বছর আমাদের ৩০টি নতুন বই আসবে। তার মধ্যে ১১টি বই ইতোমধ্যে চলে এসেছে। তবে নতুন বইয়ের মধ্যে একটাও তরুণ লেখকদের নেই।’
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত প্রবন্ধ বা গবেষণাধর্মী বই বেশি প্রকাশ করি। এসব নিয়ে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক লেখকরা মূলত বেশি কাজ করেন। তাই তাদের বই এ বছর বেশি এসেছে। তরুণ লেখকরা যে করেন না তা বলছি না।’
বইমেলার গ্রন্থ উন্মোচন মঞ্চের উপস্থাপকের সহকারী তানভীর আহমেদ বলেন, ‘মেলার প্রথম দুদিন এই মঞ্চের কাজ শেষ না হওয়ায় গ্রন্থ উন্দোচন করা যায়নি। তবে মেলার তৃতীয় দিনে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন শুরু হয়। আজ (মঙ্গলবার) পর্যন্ত ১২জন লেখক আমাদের মঞ্চে এসে তাদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন। তার মধ্যে মাত্র দুজন তরুণ লেখক পেয়েছি।’
ষষ্ঠ দিনের মেলায় নতুন বই ১০৮টি
মঙ্গলবার ষষ্ঠ দিনে মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই এসেছে ১০৮টি।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ: মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জফির সেতু। আলোচনায় অংশ নেন শাহিদা খাতুন ও সৌমিত্র শেখর। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আবদুল খালেক।
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন প্রাবন্ধিক খান মাহবুব, শিশুসাহিত্যিক শেলী সেনগুপ্তা, গবেষক নিগার চৌধুরী ও কবি আহমেদ শিপলু।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি সাজ্জাদ আরেফিন, ফারহান ইশরাক এবং সৌম্য সালেক। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, ঝর্ণা সরকার ও মো. কামাল হোসেন। দলগত আবৃত্তি পরিবেশন করে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর পরিচালনায় আবৃত্তি সংগঠন ‘উদ্ভাস আবৃত্তি সংগঠন’।
আলোচনা অনুষ্ঠান
মেলার সপ্তম দিনে বুধবার বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: গোবিন্দ চন্দ্র দেব’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক প্রদীপ কুমার রায়। আলোচনায় অংশ নেবেন জয়দুল হোসেন ও সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক।