ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঘর নির্মাণ করছেন সোহাগ আলী। কিন্তু সেই ঘরের কাজ ‘আটকে’ দিয়েছে একদল পাখি। ওরা বাসা বেঁধেছে চারপাশ ঘিরে দেয়াল তোলা ঘরের মেঝের পেয়ারা গাছে।
পাখির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা আর ওদের বাসা সংকটের কথা বিবেচনা করে নির্মাণাধীন ঘরের ছাউনির কাজই বন্ধ রেখেছেন ওই পাখিপ্রেমী সোহাগ।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামন্দী গ্রামের বাসিন্দা সোহাগ বলেন, ‘আমার বাড়ির উঠানে থাকা একটি পেয়ারা গাছে মাস চারেক আগে এক জোড়া মুনিয়া পাখি বাসা বাঁধতে শুরু করে। অথচ পেয়ারা গাছের চার পাশে দুই ফুটের মতো উচ্চতায় ইটের প্রাচীর নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে গেছে।
‘মাঝে থাকা পেয়ারা গাছটি আগেই কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু গাছটিতে পাখির আনাগোনা দেখে সেই সিদ্ধান্ত সাময়িক বন্ধ রাখি। এরই মাঝে ছোট্ট একটি বাসাতে ডিম পাড়ে মুনিয়া পাখি। পাখিগুলো ডিমে তা দিতেও শুরু করেছে। এই অবস্থায় পেয়ারা গাছটি কাটতে পারছি না। আমার ঘরের চালাও নির্মাণ করতে পারছি না।’
পাখির বাসা থাকায় ঘরের মাঝের পেয়ার গাছটি কাটতে পারছেন না সোহাগ। আটকে গেছে ছাউনি নির্মাণ। ছবি: নিউজবাংলা
এই পাখিপ্রেমী বলেন, মুনিয়া পাখি ডিম পাড়ার সপ্তাহখানেক পরে শুরু হয় ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি। বাতাসের গতি বেশি থাকায় পাখির বাসাটি ডিমসহ মাটিতে পড়ে যায়। বাসাটি গাছটিতে উঠিয়ে একটি প্লাস্টিকের ছোট ঝুড়িতে রাখি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাখি দুটি সেই ঝুড়িতে থাকা বাসাটিতেই আশ্রয় নেয়। সপ্তাহ দেড়েক পর বাসাটিতে চারটি ছানা জন্ম নেয়।
‘ছানাগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। আবার একটা সময় উড়তে গিয়ে বাসা থেকে মাটিতে পড়ে যেত আমি পুনরায় বাসাটিতে উঠিয়ে দিতাম। এভাবে চলতে চলতে পাখিগুলো বাসাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।’
সোহাগ বলেন, ‘পাখিগুলো আপনা থেকে চলে যাওয়ার পর ভাবি- যাক, পেয়ারা গাছটা কেটে ফেলে এবার ঘরের কাজটা শেষ করা যাবে।
‘সপ্তাহখানেক হয়েছে আমার সেই নির্মাণাধীন ঘরের লিংটেন ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। গাছটি অবশ্য সেভাবেই আছে। গাছটি আজ (রোববার) কেটে ফেলে তার উপর দিয়ে টিনের ছাউনি দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সকালের দিকে গাছটির কাছে গিয়ে দেখি, পুনরায় দুটি মুনিয়া পাখি এসে নতুন করে বাসা বেঁধেছে এবং ছয়টি ডিমও পেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ওদিকে নির্মাণাধীন ঘরে ছাউনির কাজ করার জন্য মিস্ত্রি চলে এসেছে। কিন্তু এই পাখিগুলোকে আশ্রয়হীন করতে মন চাইল না। বরং ছাউনির কাজ না করিয়ে মিস্ত্রিদেরই ফেরত পাঠালাম। পাখির বাসা ভেঙে নিজের বাসা তৈরি করব- এমনটা আমি ভাবতেও পারি না।’
ঝড়ো বাতাসে পাখির বাসা ভেঙে পড়ে গেলে সোহাগ আলী প্লাস্টিকের ঝুড়ি বেঁধে দেন। ছবি: নিউজবাংলা
জেলা বার্ড ক্লাবের সদস্য পাখিপ্রেমী মাজেদুল হক মানিক বলেন, ‘একটা সময় ছিলো আমাদের বাসা-বাড়ির আঙিনায় ও ছোট গাছপালায় পাখিরা বাসা বাঁধতো। বর্তমান সময়ে এসে নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে গাছপালা। বনায়ন কমে যাচ্ছে। তাহলে পাখিরা যাবে কোথায়?
‘পুরনো খড়ের ঘরের ভিটায় ইট-পাথরের দালান গড়ে ওঠায় পাখিরাও বসবাসের জায়গা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। ওরা বাড়ির আশপাশের গাছগাছালি এমনকি খোলা উঠানের মাঝে থাকা ছোট ছোট গাছেই আশ্রয় নিয়ে বাসা বাঁধছে। আমাদের উচিত ওদের বিরক্ত না করে নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা।’
মানিক আরও বলেন, ‘এক সময় এ অঞ্চলে ব্যাপক সংখ্যায় বাবলা গাছ ছিল। আর বাবলা গাছে থাকা পোকামাকড় মুনিয়া পাখির প্রিয় খাবার। আর বাসা বানানোর জন্যও পাখিগুলো এই গাছগুলো বেছে নিতো। এই অঞ্চলে বাবলা গাছ এখন বিলুপ্তপ্রায়। একইসঙ্গে অস্তিত্ব সংকটে আছে মুনিয়া পাখি।
‘মেহেরপুর জেলার সড়ক উন্নয়ন কাজের জন্য নির্বিঘ্নে কাটা হয়েছে লক্ষাধিক গাছ। এর ফলে এসব গাছে বাসা বেঁধে থাকা পাখিগুলো আশ্রয় হারিয়েছে। সোহাগ আলীর মতো আমরা সবাই যদি পাখির প্রতি এমন ভালোবাসা দেখাতে পারি তাহলে ওরা বাঁচবে। রক্ষা হবে প্রকৃতির ভারসাম্য।’