প্রাণ আছে এমন সবকিছুর স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধির জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টি উপাদান হলো ভিটামিন। ভিটামিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেহকে রোগমুক্ত রাখতে সহায়তা করে।
১৯২১ সালে বিজ্ঞানী ক্যাশিমির ফ্র্যাঙ্ক ভিটামিন আবিষ্কার করেন।
ভিটামিন কত প্রকার ও কী কী, তা আমরা ছোটবেলাতেই জেনেছি। আজ ভিটামিন ‘এ’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ভিটামিন ‘এ’
ভিটামিন ‘এ’ মূলত চর্বিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন। নির্দিষ্ট কিছু খাবারে প্রাকৃতিকভাবে এ ভিটামিনটি পাওয়া যায়। তাই একে স্নেহদ্রাব্য ভিটামিনও বলা হয়ে থাকে।
শরীরে ভিটামিন ‘এ’র অভাবে দৃষ্টিস্বল্পতা বা রাতকানা রোগ দেখা দেয়। অর্থাৎ, আমাদের চোখের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ভিটামিন ‘এ’ অপরিহার্য। চোখের রেটিনা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কারণে এই ভিটামিনটি ‘রেটিনাল’ নামেও পরিচিত।
ভিটামিন ‘এ’ মূলত একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং বয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের জন্যও এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি ত্বকের স্বাস্থ্য, টিস্যু গঠন, শ্লেষ্মা ঝিল্লি, বিভিন্ন কোষের কাজ, হাড় ও দাঁতের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রয়োজনীয়তা
গবেষণায় দেখা যায়, একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর দৈনিক ৭০০ মাইক্রোগ্রাম এবং পুরুষের ৯০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ গ্রহণ করা উচিত।
চলেন জেনে নিই, কী কী কারণে আমাদের ভিটামিন ‘এ’ গ্রহণ করা দরকার-
- দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
- শরীরের কোষ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে
- রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
- প্রজনন ক্ষমতা চালু রাখতে সাহায্য করে
- ত্বক সতেজ রাখে
- টিউমার ও ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে
- কোষ, ত্বক, দাঁত ও অস্থি গঠনে জরুরি ভূমিকা রাখে
অভাবজনিত সমস্যা
গুরুত্বপূর্ণ এ ভিটামিনটির অভাবে শরীরে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মাঝে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো-
- রাতকানা রোগ দেখা দিতে পারে।
- অ্যানিমিয়ায় (শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত না থাকা) ভুগতে হতে পারে।
- ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে দেখা দিতে পারে টিউমার বা ত্বক ও স্তনের ক্যান্সার
- নিশ্বাসের সমস্যা বা শ্বাসকষ্টও হতে পারে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে
- এর পাশাপাশি পুরুষদের শুক্রাণুর সমস্যাও হতে পারে
- চুল পড়লে তার প্রবণতা বাড়তে পারে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে
উপকারিতা
ভিটামিন ‘এ’র উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। চলুন দেখে নিই, শরীরে এই ভিটামিনটির বিশেষ কিছু উপকারিতা সম্পর্কে-
- ভিটামিন ‘এ’ আপনার দৃষ্টিশক্তি সংরক্ষণ করবে
- বয়সের ছাপ লুকোতে সাহায্য করবে ভিটামিন ‘এ’
- গর্ভবতী নারীদের গর্ভকালীন সময়কে সহজ করতে সাহায্য করবে এ ভিটামিন
- ভিটামিন ‘এ’ মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে বাড়াতে সাহায্য করে
- হাম রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে ভিটামিন ‘এ’
সতর্কতা
শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও অতিরিক্ত ভিটামিন ‘এ’ সেবনে হিতে বিপরীত হতে পারে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভিটামিন এ খেলে বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া ও ত্বক থেকে চামড়া ওঠার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
গবেষণা বলছে, শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ জমা থাকলে যকৃতের (লিভার) গুরুতর ক্ষতি হতে পারে। এর ফলে স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা ও অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকিও বাড়ে।
ভিটামিন ‘এ’র আধিক্যের ফলে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্টের সমস্যা ইত্যাদিও দেখা দিতে পারে।
মেয়েদের পিরিয়ডের সমস্যা, বিশেষ করে পিরিয়ড নিয়মিত না হওয়া, এমনকি বন্ধ হয়ে যেতে পারে শরীরে বেশি পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ জমা থাকলে।
শরীরে মাংসপেশী শিথিল হয়ে যাওয়ার সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
যেসব খাবারে পাওয়া যাবে ভিটামিন ‘এ’
ভিটামিন ‘এ’র অভাব বা আধিক্য- দুটোই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তাই এর ভারসাম্য বজিয়ে রেখে এটি গ্রহণ করাই উত্তম।
মূলত আমাদের দৈনন্দিন খাবারের মধ্য থেকেই আমরা ভিটামিন ‘এ’ পেয়ে থাকি। আর তার বাইরে প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে মেটাতে পারি এর প্রয়োজনীয়তা।
তবে যেহেতু রোজকার খাবার থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে এ ভিটামিন পাওয়া যায়, তাই চলুন জেনে নেই কোন কোন খাবার প্রাত্যহিক খাবারের তালিকায় যুক্ত করলে সহজেই এর চাহিদা মেটাতে পারবেন।
ভিটামিন ‘এ’ মূলত পাওয়া যায় দুই ধরনের উৎস থেকে। উদ্ভিদজাত উৎস ও প্রাণীজ উৎস।
উদ্ভিদজাত উৎসের মধ্যে হলুদ ও সবুজ শাকসবজির পাশাপাশি রঙিন ফলমূল থেকে পাওয়া যায় ভিটামিন ‘এ’। সাধারণত যে শাকসবজি বা ফলের রঙ যত গাঢ় হয়, তাতে ভিটামিন ‘এ’ বেশি পরিমাণে থাকে।
গাজর, মিষ্টি কুমড়ো, পাকা পেঁপে, মাখন, ব্রোকলি, কমলা লেবু, বাদাম, অ্যাভোকাডো, চিজ ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ থাকে।
এছাড়া, প্রাণীজ উৎস হিসেবে রয়েছে মাংসাশী প্রাণী, মাছের তেল বা তেলযুক্ত মাছ, মাংস, ডিম, কলিজা ইত্যাদি খাবার থেকে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়।
শিশুর শরীরে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাব দূর করতে মায়ের বুকের দুধ, ৬ মাস পূর্ণ হলে সবুজ-হলুদ শাকসবজি, ফলমূল, ডিম- খাওয়ালে এই ভিটামিনের অভাব দেখা দিবে না বলে বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে।
গবেষকদের মতে যে পাঁচটি খাবার খেলে ভিটামিন ‘এ’র অভাব দেখা দিবে না-
- মিষ্টি আলু
- গাজর
- পালংশাক
- ব্রকোলি
- আম
উল্লিখত পাঁচটি খাবারই সহজলভ্য ও আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার খুব পরিচিত কয়েকটি নাম। তাই শরীরের প্রাত্যহিক ভিটামিন ‘এ’র প্রয়োজনীয়তা মেটাতে উপরোক্ত খাবারগুলো নিয়মিত খাওয়ার চেষ্টা করুন।