দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকার ১৫/১৪, টিপু সুলতান রোডে খান হোটেলের সামনে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। হোটেলটির সামনে ট্রেতে সারি সারি সাজিয়ে রাখা পুরি, পিঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি, চিকেন চপ, ছোলা, ডাবলি বুট আর গরম গরম জিলাপি।
গরম গরম ভাজাপোড়া খেতে কে না ভালোবাসে! এতো সব ভাজাপোড়া থাকতেও সিংহভাগ গ্রাহকের নজর কিন্তু একটি খাবারের দিকে।
খান হোটেলের জনপ্রিয় এই খাবার হলো ‘টাকি পুরি’। ডাল পুরি, আলু পুরির নাম সবার কাছে পরিচিত হলেও টাকি মাছ দিয়ে তৈরি এ পুরির নাম অনেকেরই অজানা। তবে যারা জানেন তাদের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে এই ‘টাকি পুরি’।
বাহারী খাবার ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার জন্য বরাবরই বিখ্যাত রাজধানীর পুরান ঢাকা। প্রায় ৪০০ বছর ধরে সুস্বাদু নানা পদের খাবারের জন্য এ এলাকার সুনাম রয়েছে।
টিপু সুলতান রোডের জোড়পুল বাজারের মুখেই খান হোটেল। এটির বয়স ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। হোটেলটির প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল খান অনেক আগেই মারা গেছেন। বর্তমানে হোটেলটির ব্যবসা দেখভাল করছেন তার ছেলে বিল্লাহ খান।
পুরান ঢাকার সুস্বাদু সব খাবারের মধ্যে পুরি একটি। তবে টাকি পুরি বলতে গেলে খান হোটেলের আবিষ্কার। টাকি মাছ দিয়ে পুরি হয় এটা কেউ ভাবতে না পারলেও এমনটিই করে দেখিয়েছে এই হোটেল কর্তৃপক্ষ। শুনতে নতুন মনে হলেও টাকি পুরির বয়সও কিন্তু কম নয়, প্রায় ১৫ বছর।
সুস্বাদু এই পুরি খেতে দূর-দূরান্ত থেকেও অনেকে চলে আসেন খান হোটেলে। আর এই পুরির সুনাম ছড়িয়েছে মূলত ব্যতিক্রমধর্মী স্বাদের কারণে।
টাকি পুরির ইতিহাস
টাকি পুরির আদ্যোপান্ত জানতে চাইলে বিল্লাল খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিক্রির উদ্দেশ্যে নয়, বরং নিজেরা খাওয়ার জন্যই হুট করে একদিন টাকি পুরি তৈরি করা হয় বাড়িতে। স্ত্রীর বানানো সুস্বাদু টাকি মাছের ভর্তা খেতে খেতেই একদিন মাথায় আসে বাণিজ্যিকভাবে টাকি মাছের পুরি বানানোর পরিকল্পনা।
‘মূলত টাকি পুরির স্বাদে মুগ্ধ হয়েই দোকানে তা বিক্রির চিন্তা করি। আর এভাবেই টাকি পুরির বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু।’
তিনি বলেন, টাকি পুরি বানিয়ে হোটেলে বিক্রি শুরু করি। আর প্রথম থেকেই গ্রাহকের অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। প্রথম দিন থেকেই টাকি পুরি গ্রাহকদের মন জয় করে নিয়েছে। তাছাড়া রান্নায় যে তেল ব্যবহার করা হয় তা একদম খাঁটি। একদিন ব্যবহার করা তেল আরেক দিন ব্যবহার করা হয় না বলে স্বাদটাও হয় ভিন্ন।’
রেসিপি
টানা ১০ বছর ধরে খান হোটেলে কাজ করছেন মোহাম্মদ হানিফ। তিনিই জানালেন টাকি পুরির রেসিপি।
তিনি জানান, সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে টাকি পুরির জন্য সংগৃহীত টাকি মাছের কাঁটা সূক্ষ্ণ ও সুনিপুণভাবে আলাদা করা হয়। কাঁটা ছাড়ানোর পর টাকি মাছ সিদ্ধ করে তেলে ভাজা হয়।
মাছটা ভাজা হয়ে গেলে কাঁচামরিচ, সেদ্ধ আলু, ধনেপাতা, পেঁয়াজ ও বিশেষ ধরনের মসলা মিশিয়ে বানানো হয় পুরির পুর।
এরপর পুরির ময়দায় কিমা গুজে ডুবো তেলে ভাজা হয় পুরি। ভাজার পর তেল ছেঁকে আলাদা হওয়ার পর পরিবেশন করা হয় টাকি পুরি।
মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ‘শীতে টাকি মাছ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় বলে ওই সময় পুরিতে মাছের পুরের পরিমাণও বেশি থাকে। শীতকালে নতুন কাঁচামরিচ, ধনে পাতা, কাঁচা পেঁয়াজ ইত্যাদির সংমিশ্রণে পুরির স্বাদও বেড়ে যায় কয়েক গুণ।’
চাটনি
টাকি পুরির সঙ্গে গ্রাহকের সামনে পরিবেশন করা হয় বিশেষ এক ধরনের চাটনি। চাটনি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় টকদই, সরষে বাটা, ধনেপাতা ও কাঁচামরিচ। চাইলে সঙ্গে নিতে পারবেন টমেটো সস।
টাকি পুরি বানাতে এতো যে শ্রম আর বাড়তি খরচ, দামে কিন্তু তা প্রকাশ পায় না। অন্যান্য পুরির মতোই এর দাম রাখা হয়। প্রতিটি টাকি পুরির দাম মাত্র ১০ টাকা। আবার আকারেও থাকে বেশ বড়। প্রতিদিন হাজারের অধিক টাকি পুরি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান হোটেলের কর্মচারীরা। হোটেলটিতে বর্তমানে প্রায় ৭০ জন কর্মচারী রয়েছেন।
হোটেলটিতে পুরির আরও রকমফের রয়েছে। টাকি পুরির পাশাপাশি রয়েছে চিকেন পুরি, ডাল পুরি, আলু পুরি।
ঢাকায় বিখ্যাত এই টাকি পুরি খেতে আসা রাজশাহীর ওয়াসিম রেজা বলেন, ‘বিশেষ এই পুরির কথা শুনেছি অনেকবার। আজ সশরীরে হোটেলে হাজির হয়েছে, খেয়েছিও। টাকি পুরি খেতে বেশ সুস্বাদু। সত্যিই অসাধারণ।’
হোটেলের সামনে মুদি দোকানদারি করেন সুজন মিয়া। তিনি টাকি পুরি খাওয়াটা প্রায় নিয়ম বানিয়ে ফেলেছেন।
বললেন, ‘চোখের সামনে কড়াইয়ে যখন ডুবো তেলে এই পুরি ভাজা হয় তখন না খেয়ে থাকতেই পারি না। কারণ স্বাদটা অসাধারণ।’
আট বছর ধরে হোটেলটিতে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন শওকত ওসমান। ক্রেতার ভিড় সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন। তার ফাঁকেই জানালেন, পুরান ঢাকায় একমাত্র খান হোটেলেই পাওয়া যাবে বিখ্যাত এই টাকি পুরি৷ বৃষ্টি ও শীতের সময় টাকি পুরির চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সাধারণত দিনে হাজার থেকে ১২শ টাকি পুরি বিক্রি হয় এখানে। শীতের সময় বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় ১৫শ থেকে ১৬শ পিস। বিকেল ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এখানে টাকি পুরি পাওয়া যায়।
পাঠাও ফুড, ফুডপান্ডা এবং হাংরিনাকি ডটকমে অর্ডার করেও খান হোটেলের টাকি পুরির স্বাদ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।