নাম তার অদ্ভুত। খেতে ভারি মজা। দেখতে ডালপুরি, আলুপুরির মতো হলেও মুখরোচক খাবারটির নাম খেতাপুরি।
পুরান ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় খাবার এই পুরি। এর স্বাদ নিতে যেতে হবে লালবাগ, নাজিরাবাজার, শাঁখারীবাজার, বংশালসহ বেশ কিছু এলাকায়।
প্রস্তুত প্রণালির ভিন্নতার কারণেই খেতাপুরি নামকরণ করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী খাবারটির।
অন্য পুরিতে আটা ব্যবহার করা হলেও ময়দা দিয়ে বানানো হয় খেতাপুরি। ময়দার খামিরে পুরো করে ডাল ভরে পুরি বানানো হয়। সাধারণ ডালপুরির চেয়ে খেতাপুরিতে ডালের পুর অনেক মোটা হয়।
খেতাপুরির খামির। ছবি: নিউজবাংলা
বুট, খেসারি বা মসুর ডালের সঙ্গে পুদিনা পাতা, ধনে পাতা, কাঁচামরিচ কুচি, আদা, পেঁয়াজ, রসুনবাটা ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে মিশ্রণ বানানো হয়, যা মূলত খেতাপুরির পুর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পুর যত ভালো হবে, খেতাপুরি তত মজা হবে। এরপর হালকা তেলে তাওয়ায় ভেজে তৈরি করা হয় খেতাপুরি।
অল্প আঁচে ধীরে ধীরে ভাজা হয় খেতাপুরি। ছবি: নিউজবাংলা
খেতাপুরি নামকরণ যেভাবে
লালবাগ কেল্লার ২ নম্বর গেটের পাশে ১৫ বছর ধরে খেতাপুরির দোকান চালাচ্ছেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম। দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পুরি বিক্রি করেন তিনি।
লালবাগ কেল্লার দেয়ালঘেঁষা মোহাম্মদ ইব্রাহীমের খেতাপুরির দোকান। ছবি: নিউজবাংলা
ইব্রাহিম জানান, প্রথমে ময়দার সঙ্গে তেল ও পানি মিলিয়ে খামির প্রস্তুত করা হয়। এরপর রুটির সঙ্গে বাসা থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বানিয়ে আনা ডাল ব্যবহার করা হয়।
খেতাপুরির অনন্য উপকরণ ডাল। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘ডাইলে মসলা আছে, লেবু আছে। কাঁচামরিচ, পুদিনা, ধৈন্যা (ধনে পাতা), দারচিনি, এলাচের গুঁড়া আছে; জয়ফল আছে, তারপর হলুদ আছে। এগলা মিলায় ডাইল বানায়া খামিরের মধ্যে ভরি আরকি। তারপর ত্যালে ছাড়ি।’
পুরির নাম খেতাপুরি কেন, এমন প্রশ্ন করলে ইব্রাহিম বলেন, ‘খেতাপুরি বানায় রাখলে নরম হইয়া যায়। ভাইজা রাখলে একটু পর পোতায় যাইবগা। পোতায় যায় দেইখেই এইডার নাম দিসে খেতাপুরি। আগের মুরব্বিরা এই নাম রাইখা গেছে। আমরাও তাই এইডারে খেতাপুরি কই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডাইলপুরি ভাজলে শক্ত হইয়া যায়। আর এইডা (খেতাপুরি) থাহে নরম। ওইডার (ডালপুরি) মদ্যে ডাইল কম দেয়, এইডার মদ্যে ডাইল বেশি। এইডাই পার্থক্য। আর কিছু নাই।’
অভিজ্ঞ এ কারিগর জানান, খেতাপুরি নরম রাখতে অল্প তাপে, কম তেলে ধীরে ধীরে ভাজতে হয়। এ জন্য কেরোসিনের চুলা ব্যবহার করা হয়। গ্যাসের চুলায় এভাবে পুরি ভাজা যায় না।
মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ছোট ভাই কারিগর আবদুল জব্বার বলেন, ‘দাদারা-চাচারা যে করত, হেরা কইত্তে এই নাম পাইল, এইডা আর আমরা জানি না। এই পুরি আমরার চাচারা বানাইত; চাচাগোর থেইকা আমরা শিখছি। আসল হইল খামির। খামিরে ৫-৬ কেজি ময়দার ভিতরে ৩ পোয়া ত্যাল দিবেন আর লবণ দিবেন। বাস্।’
বংশপরম্পরায় খেতাপুরির দোকান চালাচ্ছেন দুই ভাই ইব্রাহিম ও জব্বার। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি আরও বলেন, ‘হোটলের ভিতরে যেইডা ভাজে (ডালপুরি), সেইডায় এইরাম খাস্তা (পুর) দিব না। এর (খেতাপুরি) খামিরডা নরম, খাস্তা বেশি। সুন্দর কইরা ভাজুম, ডাইল বেশি। এইডার খায়ই ডাইল। ডাইলডা বেশির কারণেই এইডা নরম হইয়া যায়। এইডায় মজা বেশি। খাইলে বুজতে পারবেন, ট্যাশ আছে।’
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খেতাপুরি। ছবি: নিউজবাংলা
‘এটার টেস্ট অন্যরকম’
গাজীপুরের টঙ্গী থেকে খেতাপুরির স্বাদ নিতে এসেছেন সজল ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘২০০৮ সাল থেকে খাইতাছি আমি। এইদিকে আসলেই আসা পরে (পুরির দোকানে)। এমনকি যখন মনে চায়, তখনই চলে আসি এই পুরির টানে।’
গাজীপুরের টঙ্গী থেকে খেতাপুরির স্বাদ নিতে এসেছেন সজল ভূঁইয়া। ছবি: নিউজবাংলা
পুরি খেতে খেতে তিনি বলেন, ‘অতুলনীয় স্বাদ ভাই! এত অন্তরঙ্গ মনে হয় যে, মানে আত্মা থেকে টানে এইডা আমার খাইতে। দুই-চারটা খাই, আট-দশটা নিয়া যাই পার্সেল।’
খেতাপুরি কিনতে আসা লালবাগের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘অন্য পুরির চাইতে এইডা ভালা। খাইতে স্বাদ লাগে। এমনে খাইতেই মজা। টক দইয়ের আচার দিয়া খাইলে আরও মজা লাগে।’
ঢাকার জুরাইন-পোস্তগোলা থেকে বাবার সঙ্গে পুরি খেতে এসেছে আট বছরের শুভ। সে বলে, ‘এটার টেস্ট অন্যরকম। অন্য পুরিতে এতকিছু (পুর) দেয়া থাকে না।’
কাজের ফাঁকে দোকানের পাশে রিকশা থামিয়ে খেতাপুরি খাচ্ছিলেন চালক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২০-২৫ বছর ধইরা এই পুরি খাই। রিকশার খ্যাপ লইয়া আইলেই এহোনও ভালো লাগে; আয়া খাই। আগে আরও উন্নত (ভালো স্বাদ) ছিল, অহন কেমন জানি। আগে আরও ছুডুবেলায় যহন খাইতাম, তহন আরও ভালো লাগত।’
২০ বছর ধরে খেতাপুরি খেতে আসেন রিকশাচালক শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: নিউজবাংলা
মিরপুর ১২ নম্বর থেকে আসা ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমি প্রায়ই এদিকে আসলে এটা (খেতাপুরি) খাই। আর, এটা প্রায় বেশ অনেক দিন ধরেই খাচ্ছি এখানে। ভেতরে একটু পুদিনা পাতা, ধনিয়া পাতার ফ্লেভার থাকে।’
‘আর হচ্ছে ডাল-টাল বেশি থাকে, আলু থাকে। এইটার ফ্লেভারটা টোটালি আলাদা। ফার্স্ট যখন খাইছি, তখন ২ টাকা করে খাইছি। ১ টাকাও খাইছি। এইটা এখন হইছে ১০ টাকারও বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাসার সবাই খেতাপুরি পছন্দ করে। আমি প্রায়ই নিয়ে যাই। এখন নিজে খেলাম আর দুইটা বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্যও কিছু নিয়ে যাচ্ছি।’
লালবাগ কেল্লার পাশে চা-সিগারেটের দোকান চালান স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী আদিল। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা ছোটোত থেকেই দেইখে আসতেছি এইখানে দোকানদারি (খেতাপুরির) চলে। উনারা (ইব্রাহিম ও জব্বার) যে বেচাকেনা করে, অনেক ভিড়ভাট্টা হয়। ভালো লোকসমাগম হয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক আসে এখানে।’
আদিল আরও বলেন, ‘নরমাল পুরি বেশি ত্যালে ভাজা, এইডায় হালকা ত্যাল, যে কারণে সবাই খাইতে পারে। আমরা পরিবারসহ এই দোকানে খাই, বাসায় নিয়া যাই। এইটার যে আলাদা স্বাদ, না খাওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারবেন না।’
‘সাগরিদের সাগরিদরা এখন ব্যবসা করে’
লালবাগ কেল্লার দেয়ালঘেঁষা মোহাম্মদ ইব্রাহীমের অস্থায়ী দোকানটিতে সন্ধ্যার পর ভিড় জমে রসনাবিলাসীদের। বসার জায়গা না থাকলেও ভোক্তার অভাব নেই। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পুরি খেতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্য।
লালবাগ কেল্লার দেয়ালঘেঁষা দোকানে রসনাবিলাসীদের ভিড়। ছবি: নিউজবাংলা
ওই দোকানটি ছাড়াও লালবাগ এলাকায় বেশ কয়েকটি খেতাপুরির দোকান রয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগ বেশ পুরোনো।
ঠিক কবে থেকে খেতাপুরির প্রচলন, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি কেউ। লালবাগের স্থানীয় বাসিন্দা জাকির আহমেদ বলেন, ‘ছোটকালেত থেইকে শুনে আসছি, স্বাধীন পিরোডের আগে (স্বাধীনতার পূর্বে) লালবাগ এলাকার কেল্লার গেটের অপজিটে একটি দোকান ছিল। সেই দোকানে এই খেতাপুরিটা বানাত। উনিই (নাম জানা নেই) সর্বপ্রথম এই লালবাগে এবং এই পুরানো ঢাকায়, উনিই ইতিহাস করছে এই খেতাপুরির।’
‘খেতাপুরির যে স্বাদ, এইডা উনিই একমাত্র এই পুরান ঢাকায় দেখাইছে। উনার আগে কেউ তৈরি করেনি। সেই দোকান এখন আর নেই। যে এটা বানিয়েছেন প্রথম, উনি এখন বেঁচে নেই। উনার ছেলেরাও কেউ ব্যবসার হাল ধরে নাই। কেল্লার ২ নম্বর গেটের সামনের দোকানে উনার সাগরিদের সাগরিদরা (শিষ্য) এখন ব্যবসা করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই পুরান ঢাকার খেতাপুরির স্বাদ কেউ নিতে পারে নাই। অন্যান্য এলাকায় খেতাপুরির নাম শুনে খেতাপুরি বানাইছে, কিন্তু নামে বানাইছে, কাজে কখনও কেউ বানাইতে পারে নাই। খেতাপুরি বানাইতে ব্যতিক্রম মসল্লা (পুর) লাগে, যে মসল্লাডা অনেকে জানেও না। এই মসল্লাডা কীভাবে মিক্স করতে হয়, যারা জানে, একমাত্র তারাই করতে পারবে। এ ছাড়া অন্য কেউ করতে পারবে না।’
হাতেগোনা কারিগর
লালবাগের গোরে শহীদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দোকান বসিয়েছেন খেতাপুরির কারিগর পঞ্চাশোর্ধ্ব মো. আবুল কাশেম। বাবার কাছ থেকে খেতাপুরি বানানো শিখেছেন।
কাশেম বলেন, ‘আট আনা থেইকে আমার বাবা এই পুরি বেচা শুরু করছে। এখন বেচি ৫ টাকা। আল্লায় (বাবাকে) এহনও জীবিত রাখছে, সে এহনও বিক্রি করে। তার কাছ থেইকেই আমার শিখা।’
কাশেমের দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০টি খেতাপুরি বিক্রি হয়। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা।
তিনি বলেন, ‘মসল্লা মজার কারণে দূরদূরান্ত থেইকে লোকজন আহে, নিয়া যায়। অনেক গরব (গর্ব) লাগে। এতদূর থিইক্যা পুরি নিতে আমার কাছে আসে, আনন্দ লাগে।’
আবুল কাশেমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরান ঢাকায় হাতেগোনা কয়েকজন খেতাপুরি বানান। এর মধ্যে লালবাগ চৌরাস্তার আশপাশে বসেন তিন থেকে চারজন। এ ছাড়া নাজিরাবাজার, বংশাল এবং নবাবগঞ্জেও এই পুরি পাওয়া যায়।
পুরান ঢাকায় খেতাপুরির দোকান। ছবি: নিউজবাংলা
খেতাপুরির নাম নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাবায় বলছে, আগে যারা বিক্রি করত, তখন ছিল সাদা; চাইলের আটা দিয়া বানানো। ওইটা খোলায় সেঁক দিয়া ভাজত, ত্যাল ছাড়া। ওইডা একটু মোটা থাকত। দ্যাখতে খেতার (কাঁথা) মতো বইল্লা মুরব্বিরা নাম রাখছেন খেতাপুরি। ওই ঐতিহ্যই চলতাছে এখন।’
প্রস্তুত প্রণালি একই, নাম ডালরুটি
কাশেমের কথার সূত্র ধরে খেতাপুরির আদি সংস্করণের সন্ধান করেছে নিউজবাংলা। পুরান ঢাকার বংশালের এক পিঠার দোকানে দেখা মেলে তার, তবে নাম আলাদা। খেতাপুরি নয়, এটি এখন ডালরুটি নামে পরিচিত। পুর প্রস্তুত প্রণালি একই; পার্থক্য খামির আর রন্ধন কৌশলে। চালের আটায় বানানো ডালরুটি তাওয়ায় স্যাঁকা হয়। অল্প আঁচে, ধীরে ধীরে কাঁচা পুরির সাদা রং বাদামি হয়ে গেলে ভাজার প্রক্রিয়া শেষ হয়।
তেল ছাড়াই তাওয়ায় সেঁকে তৈরি হয় ডালরুটি। ছবি: নিউজবাংলা
একই এলাকার পাশের এক গলিতে দেখা মেলে আরেকটি দোকানের। ফুটপাতে বসা দোকানটির কারিগর মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘খেতাপুরি ত্যালে ভাজে। এইডা (ডালরুটি) ত্যাল ছাড়া ভাজা হয়। শুধু তাওয়ায় ছ্যাঁক দিয়াই ভাজি।’
এই দোকানে ডালরুটি কিনতে আসা রুবেল হোসেন বলেন, ‘একই জিনিস, তেলে ভাজলে খেতাপুরি, তাওয়ায় সেঁকলে ডালরুটি। দুইটাই খেতে মজা। তয় খেতাপুরির চল একটু বেশি।’
তেল ছাড়া ভাজা হয় ডালরুটি। ছবি: নিউজবাংলা
বাড্ডা থেকে পুরান ঢাকায় ঘুরতে এসেছেন সাইক্লিস্ট মশিউর রহমান। শখের বসে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে মুখরোচক খাবার খাওয়াই তার উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, ‘খেতাপুরি আর ডালরুটি দুটোই আমি খেয়েছি, তবে কেল্লার গেটের খেতাপুরির স্বাদ অনন্য। ডালরুটিতে তাওয়ার ছেঁক দেয় বলে আমার কাছে একটু কাঁচা কাঁচা লেগেছে। এ ছাড়া সবই ভালো।’
খেতাপুরির আদি সংস্করণ ডালরুটি। ছবি: নিউজবাংলা
খেতাপুরি, ডালরুটির মতো এমন অনেক মুখরোচক খাবার পাওয়া যায় পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে। বাহারি এসব খাবারের ভিড়ে ঐতিহ্যবাহী খেতাপুরির স্বাদ আস্বাদনে যেতে পারেন যেকোনো দিন। দোকানগুলোতে সন্ধ্যার পর বেশ ভিড় থাকে। তাই অপেক্ষাকৃত আরামে খেতে যেতে পারেন বিকেলে।