বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মনিরুল ইসলামের ‘পথ ভোলা পথিকেরা’ যেন ঘৃণার জমিনে ভালোবাসার চাষাবাদ

  • আনিচুর রহমান   
  • ১৮ মে, ২০২৩ ০০:০৭

দেশি-বিদেশি দোসরদের মদদে ঘৃণা আর জিঘাংসার আগুনে ঝলসে যাওয়া ইসলামি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীকে কি মোকাবেলা করতে পারবেন আহমেদ শাহরিয়ার? বইয়ের শুরুতেই এই রোমাঞ্চ পাঠকের মনে সঞ্চারিত হয় যা তাকে টেনে নিয়ে যাবে বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা অবধি।

মনিরুল ইসলামের ‘পথভোলা পথিকেরা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আহমেদ শাহরিয়ার একজন পুলিশ কর্মকর্তা। প্রথম পরিচ্ছেদেই দেখা মেলে নেকড়ের মতো হিংস্র, নিরোর মতো নিষ্ঠুর আবু মোস্তাকিমের মুখোমুখি দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পুলিশ কর্মকর্তা আহমেদ শাহরিয়ার।

উপন্যাসের গল্প এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে আবু দুজানার সাথে আবু মোস্তাকিমের ব্যক্তিত্বের সংঘাত; হাফেজ আবু দুজানার চারিত্রিক দৃঢ়তার বিপরীতে আবু মোস্তাকিমের চরিত্রের নীতিবর্জিত কঙ্কাল। আবু মোস্তাকিমের সমকামিতাও আবু দুজানার নজর এড়ায় না।

উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে কাগজের ক্যানভাসে শব্দের রংতুলিতে লেখক নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্ন চরিত্রের মনোজগতের নানা টানাপোড়েন। তিনি কেবল ঘটনার ধারা বর্ণনা করে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখেননি; বরং প্রতিটি চরিত্রের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থার সাথে ব্যক্তিমনের সংঘাত ও অভিযোজনের চিরকালীন দ্বন্দ্বের দিকটিও তুলে ধরেছেন।

উপন্যাসে বর্ণিত ‘পিওর হার্ট বেকারি’ রেস্তোঁরায় চূড়ান্ত হামলায় অংশ নেয়া পাঁচ তরুণের ব্যক্তি-জীবনের হতাশা, বেদনাও চোখ এড়িয়ে যায় না।

শহীদি মৃত্যুর স্বপ্নে বিভোর কৈশোর উত্তীর্ণ পাঁচ তরুণকে সঙ্গে নিয়ে নেকড়ের পালের মত পায়ে পায়ে রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে তাদের দীক্ষাগুরু। লক্ষ্য, বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় করা ঘটনা ঘটিয়ে দেশে এক নতুন জিহাদের সূচনা করা। তাদের এই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা রুখে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রস্তুতি নেন আহমেদ শাহরিয়ার ও তার সহকর্মীরা।

দেশি-বিদেশি দোসরদের মদদে ঘৃণা আর জিঘাংসার আগুনে ঝলসে যাওয়া ইসলামি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীকে কি মোকাবেলা করতে পারবেন আহমেদ শাহরিয়ার? বইয়ের শুরুতেই এই রোমাঞ্চ পাঠকের মনে সঞ্চারিত হয় যা তাকে টেনে নিয়ে যাবে বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা অবধি।

‘পথ ভোলা পথিকেরা’ উপন্যাসে দানবের বিরুদ্ধে মানবের চিরন্তন সেই লড়াইয়ের গল্পই লেখক বলেছেন সুনিপুণ মুন্সিয়ানায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশের সহজিয়া সমাজের নকশায় কলঙ্কের আচড় দেয়া নৃশংস উগ্রপন্থি হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাই, রাজধানী ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে। দেশি-বিদেশি ২২ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া সেই হামলার ঘটনাকে প্লট হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্যক্তি জীবনে পুলিশ কর্মকর্তা, স্পেশাল ব্রাঞ্চের বর্তমান এডিশনাল আইজিপি, কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান মনিরুল ইসলাম। ইসলামী উগ্রপন্থিদের আতুঁড়ঘরের ত্তত্ত্ব তালাশ তিনি করেছেন পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ মনিরুল ইসলাম এই উপন্যাসে সেই অভিজ্ঞতার বয়ান করেন কেন্দ্রীয় চরিত্র আহমেদ শাহরিয়ারের জবানিতে। উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে নজর করলেই চোখে পড়ে, “উৎসর্গ সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে আত্মোৎসর্গকারী পুলিশ সদস্য ও সন্ত্রাসবাদের শিকার সকল দেশি-বিদেশী নিরীহ মানুষ।” গাইবান্ধার সাঘাটার আবহাওয়ার বর্ণনা দিয়ে “পথ ভোলা পথিকেরা” উপন্যাসের সূচনা। উপন্যাসের বিভিন্ন পর্বে নানা ঘটন-অঘটনের বর্ণনায় এই আবহাওয়ার বর্ণনা প্রতীকী গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়। পুলিশ অফিসার আহমেদ শাহরিয়ারের চরিত্র চিত্রায়নে লেখকের সংযম ও প্রজ্ঞা বিশেষভাবে নজর কাড়ে। আহমেদ শাহরিয়ার এক চিন্তাশীল গবেষক; ধ্যানী ঋষি; পেশাদারত্বের উৎকর্ষ দিয়েই মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নেন উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের। সেই পেশাদারত্বের জায়গা থেকেই তিনি এ দেশের জঙ্গিবাদের সলুক সন্ধান করতে খুঁজে ফেরেন দার্শনিক ভীত। বিস্তৃত পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে আহমেদ শাহরিয়ার পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেন ইসলামী উগ্রপন্থিদের বহুল চর্চিত ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ সম্পর্কিত পাঁচটি হাদিস। ‘জঙ্গি’ হিসেবে উল্লেখ করে তাদের দার্শনিক বৈধতা দিতে নারাজ। প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে ইসলামী উগ্রপন্থিদের উৎস থেকে বিকাশের নানা পর্যায়। ১৯৮০-এর দশকে মার্কিন মদদে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী তালেবান গঠন থেকে শুরু করে ২০১০ সালের আরব বসন্ত, আইএসআইয়ের প্রতিষ্ঠা, আবু বকর আল বাগদাদীর তথাকথিত খেলাফাত প্রতিষ্ঠার আদ্যোপান্ত। উপন্যাসের বিভিন্ন পর্বে দেখা মেলে আহমেদ শাহরিয়ারের স্ত্রী সামিরা, আবু মুরসালিনের স্ত্রী সালেহা, আব্দুল করিমের স্ত্রী ফাতিমার, তবে এসব চরিত্রের কোনোটিই লেখকের কাছে কোনো স্পেস পায়নি; বরং লেখক অনেকটা নির্দয় হয়েই যেন সামিরা চরিত্রকে বিকশিত হতে দেননি বলে প্রতিতি জম্মে। ‘পথ ভোলা পথিকেরা’ এ দেশের ইতিহাসে অন্যতম স্পর্শকাতর ইস্যু ইসলামী উগ্রবাদী তৎপরতার বৃত্তান্ত নিয়ে রচিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। ঘটনার ধারা বর্ণনায়, চরিত্র চিত্রনে লেখক পরিমিতির স্বাক্ষর রেখেছেন। ভয়ংকর ঘটনার বর্ণনাতেও তিনি সীমিতসংখ্যক বাক্য দিয়ে নৃশংসতা চিত্রিত করেন। পাঠককে গল্পের ভেতর ধরে রাখতে তিনি বর্ণনায় বাহুল্যর পরিবর্তে বেছে নেন ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্য। সরল গদ্যে পাঠকের সাথে লেখকের আনায়াস যোগাযোগ বইটিকে করেছে সুখ পাঠ্য। শিল্পী ধ্রব এষের নান্দনিক প্রচ্ছদে কবি প্রকাশনী থেকে প্রথম প্রকাশিত ‘পথ ভোলা পথিকেরা’ এদেশে উগ্রপন্থি সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ে আগ্রহী গবেষকদের জন্য এক প্রামান্য গ্রন্থ। ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় প্রকাশিত উপন্যাস অভিবাকদের জন্য ও এক আকর গ্রন্থ বলেই প্রতীয়মান হয়। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পিতা-মাতার অলক্ষে আমাদের সন্তানেরা যেন পথ ভুলে না যায়, উপন্যাসের পরতে পরতে সেই আবেদনও স্পষ্ট।

এ বিভাগের আরো খবর