সবুজ-শ্যামল কৃষিনির্ভর মেহেরপুরে সড়ক উন্নয়ন সংস্কার প্রকল্পের কাজের জন্য কুষ্টিয়া-মেহেরপুর ২৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের দু-পাশে কেটে ফেলা হয়েছে লক্ষাধিক গাছ। এ অবস্থায় আশ্রয়হারা হয়ে পড়েছে পাখিকুল। চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে ওরা আশ্রয়হীন হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে।
বাস্তবতা হলো, প্রকল্প কাজে যেসব কাজ কাটা হচ্ছে সেগুলোর বাসিন্দাদের দিকে কারও খেয়াল নেই। গাছগুলোতে থাকা পাখির বাসায় ডিম বা ছানা আছে কী না তা লক্ষ্য করার সদিচ্ছাটুকুও কারও নেই।
জেলার ওপর দিয়ে চলমান মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ জনজীবনকেই স্থবির করে দিয়েছে। এ অবস্থায় নীড়হারা অগণিত পাখি জীবন বাঁচাতে ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠ-ঘাটসহ নানা স্থানে। এর মাঝে অনেক পাখিই হয়তো আশ্রয়স্থল খুঁজে পাচ্ছে। এর মাঝেই অসাধু পাখি শিকারিদের হাতে মারা পড়ছে অসংখ্য পাখি।
বিষয়টি নিয়ে পাখিপ্রেমীদের উদ্বেগকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে। তাই কোনো গাছে পাখির বাসা থাকলেও কাজ বন্ধ করার সুযোগ নেই।
তবে পাখিপ্রেমীদের আহ্বান- জীবন-সন্ধিক্ষণে নীড়হারা পাখিদের রক্ষায় স্থানীয়দের বাড়ি কিংবা মাঠে থাকা গাছে আশ্রয় নেয়া পাখিদের বাসা তৈরির ক্ষেত্রে জন্য পাখিদের বাধা কিংবা বিরক্ত না করে বন্ধুসুলভ আচরণ করে সহযোগিতা করি।
কুষ্টিয়া-মেহেরপুর ২৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের দু-পাশে কেটে ফেলা হয়েছে লক্ষাধিক গাছ। ছবি: নিউজবাংলা
সড়ক বিভাগ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়ক চার লেনের আওতায় আসায় ৬৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। চার লেনে সড়ক সম্প্রসারণ কাজের জন্য এসব গাছ কাটা পড়ছে। এর মধ্যে অনেক গাছ রয় যেগুলোর বয়স শত বছর পেরিয়ে গেছে।
বিশেষ করে বট গাছগুলো ছাতার মতো দাঁড়িয়ে ছিল সড়কের পাশে। সড়কে চলাচলকারী মানুষকে ছায়া দেয়ার পাশাপাশি পশু-পাখির আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল এসব গাছ।
সড়কে থাকা আম, জাম, লিচু, বেল, পেপল, শিশু গাছ, মেহেগনি, কড়ই, ইপিলইপিল, তেঁতুল, আম, কাঁঠাল, লিচু, নিম, শিমুল, কদমসহ শতাধিক প্রজাতির গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
আর এসব গাছে আবাস গেড়েছিল পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী পশুপাখিরা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, টিয়া, কাঠ ঠোকড়া, বন কবুতর, ফিঙে রাজা, কাঠবিড়ালি, পেঁচা, বাবুই, চড়ুই, হরিয়ালসহ আরও অনেক।
মেহেরপুর বার্ডস ক্লাবের সদস্য মাজেদুল হক বলেন, ‘বতর্মান সময়ে মানুষজন পাকা দালানকোটা বানানোর জন্য প্রতিনিয়ত বন কেটে উজাড় করে ফেলছে। তাছাড়া জেলাব্যাপী য় দুই শতাধিক ইটভাটায় প্রতিনিয়ত পুড়ছে কাঠ। আর এসব ভাটাকে কেন্দ্র করে এলাকায় বন উজাড়ের মচ্ছব চলছে।
‘এর মাঝে জেলার আঞ্চলিক সড়কের পাশ দিয়েই অবশিষ্ট বেশ পুরনো গাছ ছিল। তাও বতর্মানে কেটে ফেলা হয়েছে। আর এসব গাছে বাসা করে থাকতো লক্ষাধিক পাখি, যেগুলোর খোঁজ বনবিভাগ এমনকি অনেকেই রাখে না। গাছগুলো কেটে ফেলায় এই তাপদাহের সময়ে ওদের আশ্রয়টি কোথায় হবে তা কেউ বলতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘নীড়হারা এসব পাখির জন্য আমাদের কিছু দায়িত্ব থেকেই যায়। তা হলো সড়কের পাশে বসবাসরত মানুষগুলো যদি তাদের বাড়ির উঠানে কিংবা পাশে থাকা গাছে ঝুড়ি বা প্লাস্টিকের পট টাঙিয়ে রাখে তাহলে নীড়হারা পাখিগুলো তাতে আশ্রয় নিতে পারে। এভাবে আমার বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে তাদের টিকিয়ে রাখতে পারি।’
বামন্দী বাজারে জিয়া ট্রেডার্সের দোকানের শার্টারের উপরে ডালিতে পাখির বাসা। ছবি: নিউজবাংলা
বামন্দী বাজারের পাখিপ্রেমী ও হার্ডওয়ার ব্যবসায়ী জিয়া উদ্দিন বলেন, ‘সড়কের দুই পাশের গাছগুলো কেটে ফেলা দেখে পাখিদের কথা চিন্তা করে আমার দোকানের শাটারের উপরে একটি ডালি টাঙিয়ে রাখি। বতর্মানে সেই ডালিতে এক জোড়া শালিক বাসা বেঁধে ডিম পেড়েছে। এখন আমার আমের বাগানে অর্ধশত ঝুড়ি টাঙিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি।’
একই উপজেলার নতুন ব্রজপুর গ্রামের পল্লী চিকিৎসক শাহিন আলম বলেন, ‘মাসখানেক হবে আমাদের বাড়িতে ঘুঘু পাখিরা সাতটি বাসা বেঁধেছে। এর মধ্যে পাঁচটি বাসায় ডিমও পেড়েছে। আমি ওদের বাসার নিচে প্রতিদিন একটি পাত্রে পানি দিয়ে রাকি। মাঝে মধ্যে খাবর ও দিয়ে থাকি। সকালে ওদের ডাকে ঘুম ভাঙে। আমার খুব ভালো লাগে।’
গাংনী ডিগ্রি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইশরাত জাহান কনা বলেন, ‘সভ্যতার বিকাশের প্রভাব প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর পড়ছে প্রতিনিয়ত। গাছ কাটার কারণে বিশুদ্ধ অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত হবো। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পরিকল্পনামাফিক প্রচুর সংখ্যায় গাছ লাগাতে হবে।’
মেহেরপুর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস টি হামিম হায়দার বলেন, ‘দেশে প্রতিনিয়তই জনসংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে সড়কে চলাচলকারী লোকের সংখ্যাও। আর বতর্মান সময়ে সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য কেটে ফেলা হচ্ছে গাছ
‘নগরবিদদের পরামর্শে এসব গাছ লাগানো হলে সড়ক সম্প্রসারণে এগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াতো না। তবে দরপত্রের ১০ শতাংশ অর্থ পুনরায় গাছ লাগানোর জন্য বরাদ্দ থাকে। সড়ক নির্মাণ শেষ হলেই পুনরায় গাছ লাগানো হবে।
‘জেলার মানুষের উদ্দেশে বলব, পশুপাখি পরিবেশের একটি অংশ। আর পরিবেশ থেকে কেউ হারিয়ে গেলে খোদ পরিবেশে প্রভাব পড়ে। তাই আমরা যে যার জায়গা থেকে যেন এসব পশুপাখি রক্ষায় তাদের আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করি।’