শরবত কিংবা চকবাজারের মুখরোচক খাবার নয়, ইফতারে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের বড় অনুষঙ্গ বিরিয়ানি। দীর্ঘকাল থেকে ঢাকার এ অঞ্চলে ইফতারের টেবিলে বিরিয়ানির যে কদর, তা এখনও কোনো অংশে কমেনি। ঢাকার এ অংশে পরিবার-পরিজন নিয়ে মজাদার খাবারটি দিয়ে ইফতার সারেন অনেকে।
ইফতারে বিরিয়ানির আগমন কবে
পুরান ঢাকায় ১৯৩৯ সালে হাজী বিরিয়ানি, ১৯৫০ সালে মাখন বিরিয়ানি, ১৯৬০ সালে শাহ্ সাহেবের বিরিয়ানি, ১৯৬২ সালে হাজী নান্না বিরিয়ানি, ১৯৭৫ সালে হানিফ বিরিয়ানির যাত্রা শুরু হয়।
ঢাকার আদি বাসিন্দাদের ইফতারে কবে থেকে বিরিয়ানির প্রচলন, সে বিষয়ে প্রবীণ অনেকে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন।
কেউ কেউ বলছেন, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় থেকেই পরিবারের সবাই একত্রে বিরিয়ানি দিয়ে ইফতার শুরু করেন। তখন থেকেই এর প্রচলন শুরু হয়। আবার কারও কারও ভাষ্য, পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের ইফতারে বিরিয়ানির চল ৮০ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
নামী দোকানগুলো কোথায়
মান ও স্বাদের জন্য কাজী আলাউদ্দিন রোডের হাজির বিরিয়ানি, হানিফ বিরিয়ানি, মৌলভীবাজার রোডের নান্না মিয়ার বিরিয়ানি, উর্দু রোডের রয়েল বিরিয়ানি, কাশ্মীর বিরিয়ানি হাউস, বিক্রমপুর কাচ্চি বিরিয়ানি, নাজিমুদ্দিন রোডের মামুন বিরিয়ানি বিখ্যাত। এ ছাড়া জনসন রোডের স্টার হোটেল, কালামস কিচেন, ক্যাফে ইউসুফ, ইসলামিয়া রেস্তোরাঁ, আল ইসলাম রেস্টুরেন্ট, মতিঝিল ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, বাবুর্চিখানা ও নর্থ সাউথ রোডের হোটেল আল রাজ্জাকের বিরিয়ানির কদরও কম নয়।
দাম কেমন
এসব দোকানে কাচ্চি কিংবা অন্য বিরিয়ানির প্লেট ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর সঙ্গে বোরহানির দাম ২৫ টাকা থেকে শুরু করে ৬০ টাকা গ্লাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিরিয়ানির পাশাপাশি এসব দোকানে তেহারি ও মোরগ পোলাও পাওয়া যায়।
ভোক্তাদের অভিজ্ঞতা
পুরান ঢাকা ঘুরে প্রায় প্রতিটি সড়কেই পাওয়া যায় বিরিয়ানির গন্ধ। দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড়। সবাই প্যাকেটে করে বাসা ও অফিসে নিয়ে যাচ্ছেন খাবারটি। ব্যস্ত থাকেন হোটেলকর্মীরাও।
অধিকাংশ বিরিয়ানির দোকানের আয়তন খুবই ছোট। এসব দোকান ও হোটেলে বিভিন্ন পরিমাণ গরু, খাসি, মুরগির বিরিয়ানি পাওয়া যায়।
পুরান ঢাকার ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী ইউছুব আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি প্রায় ২৫ বছর ধরে সদরঘাটে কাপড়ের ব্যবসা করি। এ দীর্ঘ সময়ে পরিবারের সবাই মিলে বিরিয়ানি দিয়েই ইফতার করে আসছি। বছরের পর বছর এ বিরিয়ানি ইফতারের টেবিলে একক আধিপত্য বিস্তার করে আসছে।
‘বিরিয়ানি ছাড়া ইফতারে অন্য কিছু যেন কল্পনাই করা যায় না। সময়ের পরিবর্তনে স্বাদের ভিন্নতা আর বিরিয়ানির ধরন পাল্টে গেছে।’
সদরঘাটের লালকুঠি ক্লাবের পাশে কথা হয় আফরোজা বেগম নামে প্রাপ্তবয়স্ক এক নারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ইফতারে বিরিয়ানি তো অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। নাতি-নাতনি, পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে বিরিয়ানি দিয়েই কোনো ঝামেলা ছাড়াই ইফতার করা যায়।
‘আমাদের পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের আধুনিক খাবারদাবার চলে না। আমরা বিরিয়ানিতেই অভ্যস্ত।’
মিরপুর থেকে পরিবার নাজিরাবাজারে কাচ্চি খেতে আসা আহমেদ শফিক বলেন, ‘পুরান ঢাকার কাচ্চির স্বাদ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তাই তো শত ব্যস্ততার মাঝেও এত দূর থেকে সবাইকে নিয়ে ইফতার করতে এখানে এসেছি, তবে দাম বাড়লেও পরিমাণ অল্প কমেছে। দোকানভেদে স্বাদের ভিন্নতা রয়েছে।’
দোকানের কর্মী ও ম্যানেজারের ভাষ্য
ইসলামপুরের বাবুর্চিখানার দোকানকর্মী ফরহাদ রানা জানান, পুরান ঢাকায় কাচ্চি বিরিয়ানির অনেক চাহিদা। আগে থেকে অনেকে অর্ডার করে থাকেন। রমজানের প্রথম দিন থেকেই বিক্রি মোটামুটি ভালোই। অধিকাংশ ক্রেতা পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা।
নাজিরাবাজারের হাজির বিরিয়ানির ম্যানেজার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘পুরান ঢাকার মানুষদের কাছে ইফতার মানেই বিরিয়ানি। কেউ পরিবারের জন্য নেয়, কেউ ইফতার মাহফিলের জন্য, কেউ বা আবার বড় কোনো অনুষ্ঠানের জন্য।
‘সব মিলিয়ে বিক্রি খুব ভালো হচ্ছে, তবে সব জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এতেই একটু সমস্যা হচ্ছে। অনেক জায়গা থেকে লোক এখানে খেতে আসে।’