ছেলে বা মেয়েটা কোনো কথা শুনতে চায় না। দিন দিন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় ভালো ছিল। দিন যত যাচ্ছে, ততই বেয়াদব হচ্ছে।
সন্তানকে নিয়ে যাদের এমন অভিযোগের অন্ত নেই, তাদের জন্য কথা শোনানোর কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন স্বাস্থ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিংয়ের মনোবিদ শাহানা তৃপ্তি।
সম্প্রতি প্রচারিত একটি ভিডিওতে এ মনোবিদ বলেন, ‘আমরা কি আসলে বাচ্চাকে কথা শোনাতে পারছি? ঠিক যেভাবে বললে ও শুনবে, ও মানবে, আমরা কি সেটা করছি?’
সন্তানকে বশে আনার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন শাহানা তৃপ্তি। তার ভাষায় ধাপে ধাপে সেগুলো তুলে ধরা হলো।
চোখে চোখ রেখে কথা বলা
কথা শোনানোর জন্য প্রথম প্রয়োজন বাচ্চাকে কাছে ডেকে আদর করে আই কনটাক্ট করে বাচ্চার সাথে কথা বলা; চোখে চোখ রেখে বাচ্চাকে বোঝানো; বাচ্চাকে নিয়ে নিজের আই লেভেলে নিয়ে এসে ধীরেসুস্থে আপনি কী চান, সেটা বাচ্চাকে বলা।
যোগাযোগের মাধ্যম
বাচ্চার সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কমিউনিকেশনের মাধ্যমটা খুব জরুরি। আমরা কী ভাষা ব্যবহার করছি, আমাদের ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন, আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কী থাকছে বাচ্চার সাথে, সেটা খুবই জরুরি। সুন্দর ভাষা ব্যবহার করে কথা বললে, যেটা বাচ্চা বুঝতে সহজ হবে, তার জন্য আমরা কি সে ভাষাটা ব্যবহার করছি?
মানসিকভাবে যুক্ত হওয়া, সম্মান দিয়ে কথা বলা
আরেকটা ব্যাপার। আমরা বাচ্চাকে কারেক্ট (সংশোধন) করতে চাচ্ছি। তার আগে আমরা কি বাচ্চার সাথে কানেকটেড (মানসিকভাবে যুক্ত) হচ্ছি? কারেকশনের আগে বাচ্চার সাথে কানেকশনটা খুব জরুরি।
আমার বাচ্চার সাথে যদি আমার সে রকম সম্পর্ক না থাকে, দূরত্ব থাকে, তাহলে সে বাচ্চা আমার সাথে খুব স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারবে না; বাচ্চা ভয় পাবে। আর ভয় পেলে বাচ্চা আমার কথা শুনবে না।
আগে বাচ্চার সাথে আমার কানেকশনটা জরুরি। বাচ্চার ইমোশনটাকে আমার ভ্যালিডিটি (আবেগকে প্রাধান্য দেয়া) দিতে হবে; বুঝতে হবে ও কী বলতে চাচ্ছে। ওর ফিলিংসটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তার পরে তাকে আমি শোধরাব। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে রেসপেক্ট (সম্মান দেখানো)। সেটা আবার কেমন কথা? বাচ্চাদেরকে কেন রেসপেক্ট করতে হবে, তাই না?
রিলেশনের একটা প্রধান শর্ত হচ্ছে সম্মান; রেসপেক্ট রাখা। সেটা ছোট-বড় সবার ক্ষেত্রেই। আমি যদি নিজে রেসপেক্ট পেতে চাই, আমাকে রেসপেক্ট দিতে হবে। সে যত ছোট বাচ্চাই হোক না কেন।
রুটিন
বাচ্চার একটা ডেইলি রুটিন থাকবে, যেখানে ডিসিপ্লিনড ওয়েতে (শৃঙ্খলার সঙ্গে) বাচ্চা বড় হতে পারবে। সে রুটিনে বাচ্চা কতক্ষণ ঘুমুবে, তার ঘুম, পড়া, খেলা এবং তার স্ক্রিন টাইম (মোবাইল, ল্যাপটপ বা এ ধরনের ডিভাইসের সামনে কতক্ষণ থাকছে), সবকিছু নির্দিষ্ট থাকবে।
বাচ্চা সকালে স্কুলে যাচ্ছে বা দুপুরে স্কুলে যাচ্ছে, সেটা বাদ দিয়ে বাকি সময়টাকে একটা ভাগ করে নিতে পারি যে আমরা, এই সময়টা ওর খেলার। বিকেলবেলা অবশ্যই বাচ্চাকে এক ঘণ্টা খেলতে দিতে হবে। এ ছাড়া একটা নির্দিষ্ট সময় থাকবে ঘুমোনোর।
আজকাল স্ক্রিন টাইম অনেক বাচ্চাদের; অনেক রাত পর্যন্ত জাগে। ঘুমের কোনো নিয়ম নেই; কোনো রুটিন নেই। সেটা করলে হবে না। একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চার ঘুমাতে যেতে হবে। কারণ পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের সবার জন্য জরুরি, বাচ্চাকে সাড়ে ১০টার মধ্যে ঘুমাতে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঘুমের দুই ঘণ্টা আগে তাকে ডিনার বা রাতের খাবার দিয়ে দিতে হবে।
তারপরে বাচ্চা ঘুম থেকে উঠবে কখন। সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর তার খাওয়া; ব্রেকফাস্ট করে যেন বাচ্চা স্কুলে যায়।
বেশির ভাগ বাচ্চারাই আজকাল সকালবেলা নাশতা না করেই স্কুলে যাচ্ছে, যে কারণে তাদের পড়ায় মনোযোগ থাকছে না; কনসেনট্রেশন (মনোযোগ) ধরে রাখতে পারছে না, পড়া ভুলে যাচ্ছে। কারণ ক্ষিধা পেটে তো পড়া মনে থাকে না।
পারিবারিক নিয়মকানুন
একটা ফ্যামিলি রুলস থাকবে। প্রত্যেকটা ফ্যামিলিতে একটা রুলস থাকবে যে, অ্যাটলিস্ট (কমপক্ষে) একটা বেলার খাবার, হয়তো ডিনার। আমরা সারা দিন শেষে সবাই বাড়ি ফিরছি, বাবা বা মায়েরা বাড়ি ফিরছেন, বাচ্চারা একসাথে বসে যেন একটা বেলার খাবার সবাই খেতে পারেন।
একটা ফ্যামিলি টাইম থাকবে, যেখানে বাবা-মা, সন্তান বা পরিবারের সবাই একসাথে বসে গল্প করা, সারা দিন তার কীভাবে কেটেছে, কী করছে, কী করেছে, এই সবকিছু শেয়ার করা। সব শেয়ারিংয়ের মাধ্যমেই আসলে বাচ্চারা বাবা-মায়ের সাথে বা প্যারেন্টসদের সাথে কানেকটেড ফিল করে এবং যত কানেকটেড ফিল করবে, তত বাচ্চারা বাবা-মায়ের সাথে সহজ, স্বাভাবিক থাকবে এবং সহজে মিশতে পারবে এবং সহজে বাবা-মায়ের কথা তারা মানবে।
অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করা
বাবা-মায়েদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে, আমার বাচ্চাকে আমি কখনোই তুলনা করব না। জোর করে কোনো কিছু মানতে বাধ্য করব না। তুলনার ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, আমরা প্রশংসা করতে পারি না বা বাচ্চাদের সবসময় তুলনা করে ফেলি।
ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে, এত গ্রেড পেতে হবে। ও পেল, তুমি কেন পেলে না? এ ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা খোঁটাও দিয়ে ফেলি। ওর বাবা-মা কি বেশি খাওয়াচ্ছে বা বেশি করছে? আমি কি করছি না?
আসলে বাচ্চাকে প্রশংসা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রত্যেকটা বাচ্চা আলাদা। আমাদের সব বাচ্চার ব্রেন আলাদা। তাদের বিহেভিয়র (আচরণ) আলাদা; তাদের পারসোনালিটি (ব্যক্তিত্ব) আলাদা।
বাচ্চাকে আমার প্রশংসার মাধ্যমে তাকে উপযোগী করে তৈরি করতে হবে। বাচ্চা যেন উদ্বুদ্ধ হয়; যেকোনো বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। বাচ্চাকে তুলনা করে ফেললে বাচ্চার মনে কষ্ট পায়; বাচ্চা আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে তার কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলে। ওর যে নিজস্ব একটা যোগ্যতা আছে, একটা ক্ষমতা আছে, সেটা আর সে মনে রাখতে পারে না।
অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ না করা
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের অতিরিক্ত শাসন করা যাবে না। তাই বলে কি আমরা বাচ্চাদের শাসন করব না? নিশ্চয়ই করব, তবে সেটা যৌক্তিক পদ্ধতিতে।
ধরা যেতে পারে বাচ্চারা খেলা করছে। খেলার পরে সে খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখল না। সে ক্ষেত্রে তাকে বলতে হবে, যদি তুমি খেলনা গুছিয়ে না রাখো, তাহলে সে খেলনা পরবর্তীতে খেলার আগে কিছুক্ষণের জন্য তাকে খেলতে দেয়া যাবে না। মানে তালা দিয়ে রাখা বা আটকে রাখা।
এটা একটা লজিক্যাল ব্যাপার যে, যদি তুমি গুছিয়ে না রাখো তোমার খেলনা, আরেকজনকে যদি গোছাতে হয়, তাহলে তো তুমি খেলতে পারছো না। অন্যভাবে শাস্তি না দিয়ে এইভাবে যৌক্তিকভাবে বাচ্চাকে বোঝানো।
আরেকটা জিনিস হয়। বাচ্চারা হয়তো ভাই-বোনেরা মিলে অনেক সময় দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো টিভির কোনো প্রোগ্রাম দেখা নিয়ে যে, একজন এই প্রোগ্রাম দেখবে, আরেকজন অন্য একটা প্রোগ্রাম দেখবে। রিমোট নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে।
সে ক্ষেত্রে ওই মুহূর্তে কাউকেই কোনো প্রোগ্রাম দেখতে না দিয়ে রিমোটটা নিয়ে কিছুক্ষণ আটকে রাখা এবং ওই বাচ্চাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য একদম কোনো কাজ করতে না দিয়ে চুপচাপ বসিয়ে রাখা।
ধরা যেতে পারে কারও বয়স যদি ১০ হয়, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা বছরের জন্য এক মিনিট, অর্থাৎ ১০ মিনিট তাকে আলাদা করে চুপচাপ বসিয়ে রাখা। সে ক্ষেত্রে ভাই-বোনেরা বা বাচ্চারা উপলব্ধি করতে পারবে যে, তার ভুলটা কী ছিল।
এটা একটা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যে, তোমরা ঝগড়া করেছো, তোমাদের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। সে জন্য আলাদা আলাদাভাবে তাদের বয়স অনুযায়ী, তাদেরকে ঠিক সেই কয় মিনিটের জন্য চুপচাপ বসিয়ে রাখা।