ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের পদচারণায় মুখর টঙ্গীর তুরাগ তীর। শুক্রবার বাদ ফজর মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বেও একদিন আগেই শুরু হয়েছে মাওলানা সা’দ কান্ধলবী অনুসারী মুসল্লিদের বিশ্ব ইজতেমা।
বিশ্ব ইজতেমার ৫৭তম আয়োজন রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
বৃহস্পতিবার বাদ আসর পাকিস্তানের মাওলানা হারুন কোরাইশী আগত মুসল্লিদের উদ্দেশে আম বয়ান করেন। তার বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা মনির বিন ইউসুফ। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে খিত্তায় খিত্তায় অবস্থান নেয়া মুসল্লিরা বয়ান শোনেন। আজ ইজতেমা ময়দানে দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে। মাওলানা সা’দ কান্ধলবীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সা’দ কান্ধলবী জুমার জামাতে ইমামতি করবেন।
ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মো. সায়েম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ইতোমধ্যে ৫০টি দেশের ৪ হাজার ৬০০ বিদেশি মেহমান ইজতেমা ময়দানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিস্তিন থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক মুসল্লি ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন। মাওলানা সা’দ কান্ধলবীর তিন ছেলে এবং জামাতাও ময়দানে এসে উপস্থিত হয়েছেন।
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিতে বুধবার রাত থেকেই জামাতবদ্ধ মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরু করেছেন। দেশের ৬৪টি জেলার মুসল্লিরা তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল রয়েছেন। কোন জেলার মুসল্লি কোন খিত্তায় অবস্থান করবেন সে দিকনির্দেশনাও ইতোমধ্যে দেয়া হয়েছে। ময়দানে মুসল্লিদের অবস্থানও জেলাওয়ারি নির্দিষ্ট খিত্তায় (ভাগে) বিভক্ত করা হয়েছে। খিত্তা পরিচালনার জন্য রয়েছেন খিত্তার জিম্মাদাররা।
দ্বিতীয় পর্বে শতাধিক দেশের প্রায় ১০-১২ হাজার বিদেশি মেহমান আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরব্বিরা। দেশি-বিদেশি ইসলামী চিন্তাবিদ ও ওলামায়ে কেরামগণ ছয় উসুল যথা-ঈমান, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমীন, তাসহীহে নিয়ত, দাওয়াত ও তাবলীগ সম্পর্কে বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক মূল্যবান বয়ান রাখছেন। মূল বয়ান সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় তরজমা করা হচ্ছে।
এছাড়াও বিষয় ও পেশাভিত্তিক আলোচনা, নতুন জামাত তৈরি, চিল্লায় নাম লেখানো এবং যৌতুকবিহীন বিয়ের মতো আনুষ্ঠানিকতা থাকছে দ্বিতীয় পর্বেও।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার
দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমাতেও কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দ্বিতীয় পর্বেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ১০ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন ১১শ পুলিশ সদস্য। হকারদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়াও রুফটপ, ওয়াচ টাওয়ার, সিসি টিভি মনিটরিং, ডগ স্কোয়াডসহ খিত্তায় খিত্তায় পোশাকে এবং সাদা পোশাকে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কাজ করছেন। সার্বিকভাবে ইজতেমা সফল করতে প্রশাসনের সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
র্যাবের কার্যক্রম
বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তা ও নজরদারির সুবিধার্থে পুরো ইজতেমা ময়দানকে ঘিরে থাকছে র্যাবের অবজারভেশন পোস্ট। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্র করার লক্ষ্যে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে র্যাবের পর্যাপ্তসংখ্যক সদস্য ২৪ ঘণ্টা বিশ্ব ইজতেমা মাঠে পর্যায়ক্রমে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়া একটি প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পর্যাপ্ত সিসিটিভির মাধ্যমে সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করা হবে।
ইজতেমার অভ্যন্তরে ছদ্মবেশে ও বিশেষ পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি ও আভ্যন্তরীণ টহলের মাধ্যমে স্থল ফোর্স, নৌ টহলের পাশাপাশি হেলিকপ্টার যোগে পর্যায়ক্রমে টহল প্রদানের মাধ্যমে নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ ও যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
র্যাবের বোম্ব স্কোয়াড এবং স্ট্রাইকিং ফোর্স সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হবে। মুসল্লিদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে র্যাবের মেডিক্যাল টিম দায়িত্ব পালন করবে।
যানবাহন চলাচল ও পার্কিং
বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের নিরাপদ যাতায়াত এবং সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে পুলিশ বিভাগ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. আলমগীর হোসেন জানান, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু রাখতে এবার নজরদারি তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন পয়েন্টে পর্যাপ্তসংখ্যক সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সঙ্গে থাকছে আইপি ক্যামেরাও। ট্রাফিক পুলিশ তিন শিফটে দিনে ও রাতে ২৪ ঘণ্টা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবেন।
চিকিৎসা সেবা
মুসল্লিদের স্বাস্থসেবা নিশ্চিত করতে ইজতেমায় দায়িত্ব পালনকারী পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রয়েছে।
গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. খায়রুজ্জামান জানান, দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মেডিক্যাল অফিসারদের তালিকা ও ডিউটি রোস্টার করা হয়েছে। চিকিৎসা সেবায় ১১টি মেডিকেল ক্যাম্প, ৬টি বিশেষজ্ঞ টিম, একটি ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম কাজ করছে। কোভিড ক্যাম্পে দৈনিক ৫ হাজার র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট ও ৫ হাজার করোনার টিকাদেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। বিদেশি মেহমানদের জন্য সার্বক্ষণিক একটি অ্যাম্বুলেন্সসহ ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
সিটি করপোরেশেনের পরিচ্ছন্নতা অভিযান
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ জানান, মুসল্লিদের ওযু, পয়ঃনিষ্কাষণ ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ইজতেমা মাঠে স্থাপিত গভীর নলকূপ দ্বারা পাইপলাইনের মাধ্যেমে সুপেয় পানি সরববরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে ৬০০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী মাঠে দিন-রাত বর্জ্য অপসারণের কাজ করছে।
ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প
টঙ্গীর মুন্নু গেট এলাকায় মুসল্লিদের জন্য হামদর্দ, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, গাজীপুর সিভিল সার্জন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক ইউনানী হারবাল মেডিক্যাল সোসাইটি, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশন, শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জনকল্যাণ ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্প, ইবনে সিনা, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প বৃহস্পতিবার থেকে মুসল্লিদের চিকিৎসা সেবা শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চিকিৎসা নিতে আসা মুসল্লিদের অধিকাংশই জ্বর, ঠাণ্ডা ও পেটের পীড়াজনিত রোগে আক্রান্ত।