এশিয়া ও ইউরোপে বিস্তৃত তুরস্ককে বলা হয় পূর্বের সংস্কৃতি ও পশ্চিমের জীবনধারার মিলনস্থল। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন তুর্কি সংস্কৃতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের দিক থেকেও দেশটির নেই জুড়ি। একদিকে ফিরোজা নীল পানির সৈকত, অন্যদিকে গ্রিক, পারসিয়ান, লিসিয়ান, উসমানীয় সম্রাজ্যের ঐতিহ্য। এসব কারণে ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণ তুরস্ক।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে ২০২২ সালে পর্যটকের বেশ আনাগোনা দেখা যায় তুরস্কে। দেশটির সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ডেটা অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে তুরস্ক ভ্রমণ করা বিদেশির সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬৪ লাখ। পর্যটকের সংখ্যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় বাড়ে ১৮৫.৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে তুরস্কগামী পর্যটকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তুরস্কে যাওয়ার খরচ একটু বেশি হলেও দেশটি একবার ঘুরলে সিদ্ধান্তটা হয়তো অযৌক্তিক মনে হবে না।
তুরস্কে কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন এবং কী কী করবেন, তার বিস্তারিত আজ জানাব আপনাদের।
কীভাবে যাবেনতুরস্ক যেতে প্রথমেই প্রয়োজন ভিসার। দেশটির জন্য এখন অনলাইনে আবেদন করে ই-ভিসা পাওয়া সম্ভব। ভিসা পেতে ন্যূনতম ৬ মাস মেয়াদি পাসপোর্ট, হোটেল বুকিং, ব্যাংক স্টেটমেন্টের মতো কাগজপত্রের দরকার পড়ে। ঘুরতে যাওয়ার অন্তত কয়েক মাস আগে থেকে ভিসার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করা দরকার।
ভিসা নিশ্চিত হওয়ার পরই ঠিক করতে হবে ফ্লাইট বুকিং। ফ্লাইটটি সাধারণত বেশ লম্বা হয়ে থাকে। তা ছাড়া সঙ্গে থাকতে পারে ভিন্ন কোন দেশে যাত্রাবিরতিও। সরাসরি ফ্লাইটের ক্ষেত্রে সফরটি প্রায় ৯ ঘণ্টার হয়ে থাকে। তাই তুরস্কে যেতে লম্বা বিমানপথে ভ্রমণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বিমানপথে তুরস্ক যাওয়া ব্যয়বহুল হলেও একটু সচেতনভাবে বুকিং করলে কিছু খরচ বাঁচানো সম্ভব। প্রথমতই কয়েক মাস আগে বুকিং করলে ফ্লাইটের দাম সাধারণের তুলনায় কম পাওয়া যায়। বিভিন্ন এয়ারলাইনসের দামের মাঝে তারতম্য করে আপনার জন্য সেরা ফ্লাইট বেছে নিতে দেখে নিতে পারেন গোযায়ান।
এ প্ল্যাটফর্মে মুহূর্তের মধ্যে দেখে নেয়া যায় ফ্লাইটের সময়, দাম, যাত্রাবিরতির সময়, ব্যাগেজ সীমার মতে বিষয়। তাদের ওয়েবসাইট বা অ্যাপ ব্যবহার করে দেশের যেকোনো জায়গা থেকে আপনি বুক করে ফেলতে পারবেন ফ্লাইট। তাই তুরস্কের ফ্লাইট বুক করাও হতে পারে একেবারেই ঝামেলামুক্ত।
কোথায় ঘুরবেনতুরস্কের মূল আকর্ষণ গোটা ইস্তাম্বুল শহর। আয়া সোফিয়া, টপকাপি প্যালেস, ব্লু মস্ক ঘুরলে দেখতে পারবেন অসাধারণ কিছু স্থাপত্যশৈলী। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকর্মগুলোর একটি আয়া সোফিয়া। অন্যদিকে টপকাপি প্যালেস ছিল উসমানীয় সম্রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু। সূক্ষ্ম কাজ করা টাইলস দিয়ে তৈরি গোটা প্রাসাদ। এখান থেকে দিগন্ত বিস্তৃত ইস্তাম্বুলকে একনজরে দেখে নেয়া যায়। এর বাইরে ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড বাজার, রুস্তম পাশা মসজিদ, বসফরাস প্রণালির মতো গন্তব্যগুলো পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয়।
ইস্তাম্বুলের পর তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় শহর ক্যাপাডোসিয়া। শহরটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রং-বেরঙের হট এয়ার বেলুন। প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ মানুষ ক্যাপাডোসিয়া ঘুরতে যান শুধু হট এয়ার বেলুনে চড়তে। শহরটি ইট, পাথর, বালুর ভবনের পরিবর্তে গড়ে তোলা হয়েছে প্রাকৃতিক পাথর দিয়ে। খোদাই করা এসব পাহাড়ে ভবন আছে আট তলা পর্যন্ত।
বদরাম, আনাতোলিয়া, পামুক্কালে, ইজমিরের মতো শহরগুলো ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। পামুক্কালে শব্দের অর্থ ‘তুলার প্রাসাদ’। এমন নামের পেছনে রয়েছে প্রাকৃতিক ঘটনা। পামুক্কালেতে প্রাকৃতিকভাবে গরম পানির জলাধার পাওয়া যায়। সাদা পাথরের মাঝে হালকা নীল পানি দেখতে তুলার মতো বলেই এমন নামকরণ করা হয়।
সব মিলিয়ে বলা যায়, তুরস্কের একটা শহর ঘোরার চেয়ে একেবারে বেশ কয়েকটি শহরের তালিকা নিয়ে ঘুরতে বের হলেই বেশি ভালো হয়। আর কোন কোন শহর ঘুরবেন, তা বাক্সবন্দি ট্যুরের মাঝে আটকানো যায় না। এ সমস্যার সমাধান করতেও দেখে নিতে পারেন গোযায়ান। প্রতিটি শহরে থাকার জায়গা ও অ্যাকটিভিটি পছন্দ করে নিতে পারবেন একেবারে নিজের মতো করে।
কী কী খাবেনমধ্যপ্রাচ্যের কাবাবের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। সেই কাবাবের স্বাদ নিতে তুরস্কের তুলনা হয় না। মানটি, কোফতা, শিশ কাবাব, ইস্কেন্দের কাবাব, পিডে ইত্যাদি তুরস্কের জনপ্রিয় খাবার। এগুলোর সবই গরু বা ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি। খাবারগুলো তুরস্কের মোটামুটি সব জায়গাতেই পাওয়া যায়।
শুধু মাংস আর কাবাবেই আটকে নেই তুরস্কের খ্যাতি। দেশটিতে আছে বেশ কিছু জনপ্রিয় নিরামিষ খাবারও। লতা দিয়ে মোড়ানো চাল, পেঁয়াজ, পুদিনা দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী একটি খাবারের নাম ইয়াপ্রাক সারমা। দোলমা নামের একটি খাবারও দেশটিতে জনপ্রিয়, যাতে বেগুনের বা ক্যাপসিক্যামের খোসার মাঝে চাল ও পেঁয়াজের একটা সংমিশ্রণ রান্না করা হয়। তা ছাড়া হামাস, মেজেও জনপ্রিয় খাবার।
পর্যটকদের কাছে তুরস্কের স্ট্রিট ফুডের কদর আছে। সড়কের পাশে বসানো দোকানগুলোর সবচেয়ে আলোচিত খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে দুরুম নামের রোল, সিমিত নামের বিশেষ রুটি এবং বোরেক।
মিষ্টির মধ্যে তুরস্কে জনপ্রিয় হলো টার্কিশ ডিলাইট, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় লোকাম। পনির দিয়ে তৈরি কুনাফাও তুরস্কের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। আমাদের দেশের জনপ্রিয় হালুয়ার মতো তুরস্কেও এক ধরনের হালুয়া পাওয়া যায়। তবে দেশটিতে হালুয়া তাহিনি বা তিল দিয়ে তৈরি হয়।
চেখে দেখতে পারেন তুরস্কের চা ও কফি। বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো হয় চা ও কফি। গরম বালির ওপর বানানো এই পানীয়গুলোর স্বাদ একেবারেই অন্যরকম বলে দাবি করেন পর্যটকরা। তুরস্কের কফি বেশ ঘন ও তিক্ত স্বাদের হয়ে থাকে। অন্যদিকে তুরস্কের চা সুগন্ধি ও হালকা হয়।
ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সুস্বাদু খাবার—সব দিক দিয়েই অনন্য তুরস্ক। তুরস্ক যাওয়ার সেরা সময় এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। তাই এখনই পরিকল্পনা করে ফেলুন ভ্রমণের বিষয়টি।