কাগজ সংকটের প্রভাব পড়বে এবার অমর একুশের বইমেলায়। কাগজের দাম বেড়েছে। ফলে এবার বইয়ের দাম বাড়বে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।
কাগজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে কাগজ আমদানিতে লাগাম টানা আছে। এলসি (ঋণপত্র) না করতে পারার কারণে কাগজের কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না, যার প্রভাব পড়েছে কাগজের দেশীয় বাজারে। তিন মাসের ব্যবধানে কাগজের দাম হয়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি।
এবার সারা দেশে স্কুল পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা যেমন পূরণ হয়নি, তেমনি এবারের বইমেলাতেও বই সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হবে প্রকাশদের।
প্রকাশকদের মন খারাপসৃজনশীল বইয়ের প্রকাশকদের আশঙ্কা, কাগজ সংকটের কারণে এবার বই প্রকাশের সংখ্যা কমবে একুশের বইমেলায়। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একাডেমিক বইয়ে প্রতি ফর্মা বইয়ের দাম ২৭ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বইমেলা বা সাহিত্যনির্ভর বইয়েও সেরকমই দাম বাড়বে। এখন ২০০ টাকার বই ৩০০ টাকা দাম পড়বে।’
তিনি বলনে, ‘আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি, অন্তত তিন মাস শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ দিতে। এমন না যে কাগজ আমদানিতে অনেক বেশি ডলাররে প্রয়োজন হয়, তবে শুল্ক বেশি থাকা ও এলসি না করতে পারার কারণে সংকট আরও বেশি হচ্ছে।’
প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কাগজের দাম বাড়ার প্রভাব তো কিছুটা পড়বে। বাইয়ের দাম বৃদ্ধি পাবে। আমরা এখন চিন্তিত, কারণ দাম যে পরিমাণ বাড়বে, তাতে পাঠকের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে।’
মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘কাগজের দাম হয়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। এই হিসেবে বইয়ের দাম বাড়ার কথা অনেক। আমরা চেষ্টা করছি একটা সহনীয় পর্যায়ে দাম রাখতে। দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।’
শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বইমেলায় খুব কম বই ছাপাচ্ছি। অনেক বই রেডি, কিন্তু আমরা ছাপছি না। এটা আমরা লেখকদের বলে দিয়েছি। বেশি দামে কাগজ কিনে আমরা যদি বইগুলো ছাপাইও, সেটা আসলে পাঠক কিনতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘মধ্যবিত্তের হাতে টাকা নেই। কাগজের দাম বাড়ার সাথে সাথে বইয়ের দাম বাড়বে। আমাদের মুদ্রিত বইয়ের বিক্রি কমেছে। পাশাপাশি কাগজের দাম বাড়ার ফলে বইয়ের দাম বাড়বে। কাগজের দাম তো তিন গুণ হয়েছে, তাহলে বইয়ের দাম দ্বিগুণ হবে। যে বইয়ের দাম ২০০ টাকা ছিল, তা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা হবে।’
‘আল হামরা প্রকাশনী’র প্রকাশক খান মুহাম্মদ মুরসালিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কাগজের দামের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে আমাদের মতো মাঝারি মানের প্রকাশকদের। আগে আমরা কিছুটা কাগজ রেখে দিতে পারতাম, কারণ বই উৎসবের কারণে কাগজের সংকট থাকত। কিন্তু এবার এতো দাম, আর বাজারেও কাগজ না থাকায় সেটাও পারিনি।’
তিনি বলনে, ‘আমার হাতে প্রকাশের জন্য ১৫টি বইয়ের পাণ্ডুলিপি ছিল, তবে কাগজ সংকটের কারণে এখন পাঁচটা বই ছাপতে পারব।’
প্রকাশনা সংস্থা তাম্রলিপির প্রকাশক এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বই ছাপানো কমবে। বইয়ের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে চলে যাবে। কাগজের দাম একটু বেশি বেড়েছে। অন্য কিছুর দামে সরকার মনিটরিং করে নিয়ন্ত্রণে রাখলেও কাগজের ক্ষেত্রে সেটা কম।’
তিনি বলেন, ‘কাগজের দাম যেহেতু দ্বিগুণ হয়েছে, সেহেতু বইয়ের দাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এমনিতেই আমাদের সৃজনশীল পাঠক অনেক কম, আর এবারে কাগজের দামের কারণে আরও কমে যাবে।’
তবে ভিন্ন কথাও বলছেন কিছু প্রকাশক। তারা মনে করেন, কাগজের দাম বাড়ার প্রভাব মেলার বইয়ের দামে প্রভাব পড়বে না। সময় প্রকাশনীর প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দাম বাড়া নিয়ে কোনো আশংকা নেই। বইমেলায় এটার কোনো প্রভাবও সেভাবে পড়বে না। কারণ আমরা এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের সব জিনিসের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশও বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও আমাদের ক্রেতাদের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। বইয়ের দাম বাড়লেও সেটা ২০ শতাংশের বেশি হবে না।’
প্রথমা প্রকাশনের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কাগজের দামের প্রভাব বইমেলাতে থাকবে, তবে আমরা চেষ্টা করছি আমাদের দাম খুবই মিনিমাম আকারে বাড়ানোর। নতুন বই আমরা যা অর্ডার পেয়েছি, তা বই মেলায় আসবে। এবার ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বই নতুন থাকবে।’
কাগজের দামের পরিস্থিতি কীব্যবসায়ীরা জানান, দেশি ও বিদেশি– দুই ধরনের কাগজ চালু আছে বাজারে। দেশি কাগজ দিয়ে ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, কার্ড ইত্যাদি ছাপা হয়। এর মধ্যে উন্নত ধরনের কাগজের মধ্যে আছে নিম্বো আর্ট কার্ড, অফসেট পেপার ও বই ছাপানোর কাগজ। আবার সরাসরি চীন, ইন্দোনেশিয়া ও কোরিয়া থেকেও কাগজ আমদানি করা হয়।
রাজধানীর ছাপাখানাগুলোর বড় অংশের অবস্থান আরামবাগ ও ফকিরাপুল এলাকায়। সেখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে উৎপাদিত কাগজের দাম গত তিন মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ৫৫ জিএসএম পুরুত্বের কাগজের দাম এক বছর আগেও ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা, আর এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৫০ টাকা। ধাপে ধাপে বাড়ছে এই দাম।
তিন মাস আগে এ কাগজের দাম ছিল ১ হাজার ৭০০ টাকা। অন্য দিকে ৮০ জিএসএমের দাম এক বছর আগে ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা, যা এখন ৩ হাজার ২০০ টাকা। তিন মাস আগেও এই কাগজের দাম ছিল ২ হাজার ৬০০ টাকা। ডুপ্লেক্স বোর্ডের দাম ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা হয়েছে। আর্ট পেপারের দাম ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
দেশি কাগজের মধ্যে ‘বসুন্ধরা’ ও ‘ফ্রেশ বাংলা’ বেশি সমাদৃত। বাইরে থেকে কাঁচামাল বা পাল্প এনে বানানো হয় এই কাগজ। আবার চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকেও সরাসরি কাগজ আমদানি হয়। আবার ওইসব দেশ থেকেই কাগজের কাঁচামাল আনা হয়ে থাকে। তবে এখন ব্রাজিল থেকেও কাঁচামাল আনা হচ্ছে।
কাগজের দাম বাড়ার ফলে ঝুঁকিতে পড়েছেন ছাপাখানা ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, কাগজের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে কালির দামও। প্রাইড কালি যা ছাপায় ব্যবহৃত হয়, সেটি এক কেস এখন ১ হাজার ৬০০ টাকা। তিন মাস আগেও এটি ছিল ৮০০ টাকা।
মুদ্রণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, কাগজের দামের যে অবস্থা, তাতে পাঠ্যবইয়ের ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতি দেখা গেছে, সেই একই পরিস্থিতি সৃজনশীল বইয়ের বেলাতেও। বইমেলায় বইয়ের দাম অনেক বাড়বে। এতে পাঠক বই কেনার আগ্রহ হারাতে পারেন।
কী বলছেন ব্যবসায়ীরাব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার দেশি মিলগুলোকে সুবিধা দিতে গিয়ে কাগজের আমদানির ওপর ৫৯ ভাগ শুল্ক আরোপ করেছে। সেটির সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা।
আরামবাগের মদিনা পেপার হাউজের মালিক বাহারউদ্দিন বলেন, বাংলা কাগজের দাম বেশি। দেশে কাঁচামাল নেই অনেকদিন ধরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্যাসের সংকট।
বাহারউদ্দিন বলেন, ‘এক টন কাগজ আগে কেনা হতো ৯৫ হাজার টাকা দিয়ে। এখন কিনতে হচ্ছে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। এক টনে ৪৭ রিম কাগজ থাকে। ৮০ জিএসএম অফসেট, যা দিয়ে মূলত বই মেলার সৃজনশীল বই ছাপা হয়, তার দাম ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার টাকা। এই দাম এক বছরে ধাপে ধাপে বেড়েছে।’
আরামবাগের পারফেক্ট পেপার হাউজের মালিক মো. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘কার্ড আর ডায়েরি তৈরির কাগজ কিনে এনেছি, তবে কোনো বিক্রি নাই। আগে অনেক এনজিও থেকে ডায়েরি বা ক্যালেন্ডারের অর্ডার আসত। এখন তা নেমে এসেছে ২০ ভাগে। সব ধরনের কাগজের দাম এখন ৫০০ টাকা বেশি। মিল মালিককে ধরলে তো কিছু করা যাচ্ছে না। দেশে কাঁচামাল নেই। কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি করাও যাচ্ছে না।’
একই কথা জানালেন ছাপাখানা শাপলা প্রিন্টার্সের মালিক মমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগে সাত জন কর্মচারী থাকলেও এখন একজন কর্মচারী দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। অর্ডার নেমে এসেছে অর্ধেকের কমে।’